দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছরে হয়নি সেতুর ভাঙাচুরা বাঁেশর সাঁকোই একমাত্র ভরসা

শিপলু জামান: ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের তৈলকূপ গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত বেগবতি নদি। এই নদির উপর একটি সেতুর অভাবে ভাঙ্গাচুরা বাঁশের সাঁকো দিয়েই পারাপার হতে হয় ৪ ইউনিয়নের অন্তত ৫ গ্রামের মানুষের। কালীগঞ্জ শহরসহ অনান্য এলাকায় আসা যাওয়া করার জন্য এই বাঁশের সাঁকোই তাদের একমাত্র ভরসা। ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিদের বারবার প্রতিশ্রুতিতে আশ^স্থ হলেও আজো পূরণ হয়নি তাদের সেতুর স্বপ্ন। স্থানীয়দের দুর্ভোগের দিন যেন শেষ হবার নয়। তবুও আশায় বুক বেঁধে আছেন তারা। দ্রুত একটি সেতু নির্মাণ হলে ভুক্তভোগীদের দুঃখ ঘুচবে এমন প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।
অনেক আগে নলডাঙ্গা রাজবাড়ির পাশে একটি চিকন সেতু নির্মাণ করা হলেও সেটি এখন একেবারেই চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। আবার সেই সেতু দিয়ে পার হতে গেলে অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়। এবং সেতুটি এতোই চিকন যে কোনো রকম একটি ভ্যান গাড়ি মালমাল নিয়ে পার হওয়া দূষ্কর। তৈলকূপ গ্রামটি এমনই এক গ্রাম, যে গ্রামকে এক বেগবতি নদিই তিন দিক দিয়ে প্রবাহিত। শুধুমাত্র নলডাঙ্গার বাজারের পাশে উন্মুক্ত যে কারণে ভারী কোন ফসল বা অন্যান্য মালামাল পরিবহন করতে হলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয় জেলা ও উপজেলা শহরের হাট বাজারে। এজন্য চলাচলের জন্য প্রতি বছর চাঁদা তুলে নির্মাণ করা হয় বাঁশের সাঁকো। বছর পার হতে না হতেই বাঁশ পচে নষ্ট হয়ে যায়। প্রতি বছরই সাঁকো নির্মাণে খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা।
সাঁকো পার হয়ে শহরে যেতে সময় ও অর্থ দুটোই ব্যয় হয়। ভারি যানবাহন চলাচল করতে না পারায় রোগী বহন করতে স্বজনদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। অনেক দূরের রাস্তা ঘুরে আসতে হয় শহরে। কৃষিপণ্য আনা নেয়ায় কৃষকদের পড়তে হচ্ছে কষ্টে। সময়মতো কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে না পারায় বাজার মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এই অঞ্চলের কৃষকেরা। পরিবহন খরচ বাড়ে দ্বিগুণ।
এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন বয়সের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, চরম দূর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হাজার হাজার মানুষ নদী পারাপারের জন্য একমাত্র ভরসা বাঁশের সাকো। আবার এ সাকো নির্মাণের ছয় মাস যেতে না যেতেই তা নদীর পানির তোড়ে ভেঙ্গে যায়। ডোঙ্গায় পারপার হতে গিয়ে অনেকেই নদীর পানিতে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। স্কুল-মাদরাসার শিক্ষার্থীরা তাদের বই পুস্তক নিয়ে নদীর পারাপার হতে গিয়ে অনেকেই নদীতে পড়ে যায়। ফলে তাদের বই খাতা ভিজে যাওয়ায় স্কুল ও মাদরাসায় যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। এদিকে, অনেকেই ক্ষোভ নিয়ে জানান, নির্বাচন এলেই জনপ্রতিনিধিরা এ নদীর উপর দিয়ে চলাচলরত মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য সেতু নির্মানের প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান আহমেদ জানান, প্রতিদিন বেগবতি নদীর ওপর তৈরি এই দূর্বল বাঁশের সাঁকো দিয়ে আতংকিত ভাবে পারাপার হতে হয়। মনে সব সময় ভয় কাজ করে কখন যেন ভেঙে পড়ি পানিতে। তবুও উপায় না থাকায় এদিক দিয়েই যাতায়াত করি। ডিজিটাল যুগেও বাঁশের সাঁকো এটি বড়ই বেমানান প্রথা।
তেলকূপী গ্রামের আবুল কাশেম জানান, বাঁশের সাঁকো ভেঙে মাঝে মধ্যেই মানুষ আহত হন। আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমার শ্যালক অল্প কিছু কৃষি পন্য নিয়ে উপজেলা শহর কালীগঞ্জে যাওয়ার জন্য এই সাঁকো ভেঙে তিনি নিচে পড়ে যান এবং সাকোঁর বাঁশে লেগে তার এক চোখে মারাত্বক আঘাত পায়। পরে বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়ে তার চোখ ভালো হয়নি। পরে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। আজ থেকে ৪ বছর আগে আমার স্ত্রী অসূস্থজনিত কারণে ষ্ট্রোক করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাকোঁর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সাঁকো ভেঙে নিচে নদির পানিতে পড়ে যায়। সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। এই তো কিছুদিন আগেও সাইকেল নিয়ে পার হতে গিয়ে শমসের আলী নামের একজন সাইকেলসহ পানিতে পড়ে যায়। স্থানীয়রা ছুটে গিয়ে তাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছি। নিহত আহত হলেও কারোরই টনক নড়েনি। এখানে একটি সেতু নির্মাণ দেখে যেতে চান তিনি।
তৈলকূপী গ্রামের নদি পাড়ের নুরজাহান বেগম জানান, বর্ষার সময় তালের ডোঙ্গা দিয়ে পার হতে হয়। পানি কমে গেলে বাঁশের সাঁকো। জরুরি চিকিৎসা নিতে শহরে গেলে এখানে অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমাদের দুর্দশা ঘুচাতে সরকারি সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কলেজ ছাত্রী জানান, আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সেতু কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।। জানি না এ স্বপ্ন বাস্তবে কোনদিন রূপ নিবে কী-না। কারণ এখানে বছরের ৬ মাস পানি থাকে এবং বাকী ৬ মাস বাঁশের সাঁকোতে পারাপার হতে হয়। অর্থাৎ বছরের কার্তিক মাসে তৈরি করা হয় বাঁশের সাকো। বছরের পর বছর ধরে এরকম দূর্ভোগ ও ভৈাগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে শত শত মানুষকে। সে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি প্রতিদিন ঐ ভাঙ্গাচোরা বাশেঁর সাকোঁ দিয়ে পার হয়ে নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বারোপাখিয়া মসজিদের মোড়ে এসে তাকে ইজি বাইক, ভ্যান অথবা লাটা হাম্বারে চড়ে কালীগঞ্জ শহরে পৌঁছায়ে। এরপর বাসে চেপে তাকে যশোর যেতে হয়। তিনি বলেন, এ নদী পারাপারের একমাত্র ভরসা বর্ষার সময় তালের নৌকা (ডোঙ্গা) আর এখন একটি বাঁশের সাকোঁ। তাও আবার বর্ষা আসলেই নদীর পানির ¯্রােতে ভেসে যাবে। ফলে বছরের ছয় মাস সাকো দিয়ে এবং বাকি ছয় মাস ডোঙ্গা দিয়ে এ নদী পারাপর হতে হয় তিন ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের শত শত মানুষকে। এতে চরমভোগান্তি আর দুর্ভোগে পোহাতে হয় ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

স্কুল শিক্ষক ফুলছার আলী বলেন, এই গ্রামের মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে জেলা ও উপজেলা শহরে যায়, তারা সারা জীবনই এই দূর্ভোগ সঙ্গে নিয়ে তাদের চলতে হয়। তাছাড়া নদির ওপারে বারোপাখিয়া মাদরাসা এবং নরেন্দ্রপুর ঘোষনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীরা এই সাকো দিয়েই তাদের পারাপার হতে হয়। তারাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দূর্ভোগে পড়েছে। কোনো কারণে যদি এখানে সেতু নির্মান করা সম্ভব না হয় তাহলে গোয়ালবাড়ি ঘাটে সেতু নির্মান করা হলেও আমাদের সমস্যা সমাধান হবে। আমাদের অনেক সরকার প্রতিনিধি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। নদির উপর একটি সেতু নির্মাণ হলে দুপারের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী সৈয়দ শাহরিয়ার আকাশ বলেন, তৈলকূপী গ্রাম এবং রাজবাড়ির পাশে যে পুরাতন সেতুটি আছে সেখানে আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখে নতুন করে একটি সেতু নির্মানের জন্য টেন্ডার দিবো কিন্তু দু’পাড়ের বসতিরা জায়গা দিচ্ছে না এজন্য টেন্ডার করাতে পারছিনা। সেতুটির ডিজাইন আছে ১৮ ফুট, সেখানে আমার জায়গা লাগবে ২৪ ফুট। কিন্তু নদির ওপারে দুই পাকা বাড়ি আছে তারা জায়গা দিচ্ছেন না। এ কারনে সেখানে সেতুর নির্মাণ করার প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর আপনি নতুন যে জায়গার কথা বলছেন, সেটা আমার নলেজে নেই। যদি এলাকাবাসী জায়গা নির্ধারণ করে তাহলে তারা জেলা প্রকৌশলী অথবা আমার বরাবর আবেদন করলে আমি আমার উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা ব্যবস্থা করা যাবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More