মৃত্যুবার্ষিকীতেও ব্যারিস্টার বাদলকে কেউ মনে রাখেনি

রহমান মুকুল: ২৩ জুন ছিলো প্রায়াত ব্যারিস্টার বাদল রশিদের মৃত্যুবার্ষিকী। পূর্বাপর এ বছরেও বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও অন্যতম সংবিধান রচয়িতা ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে স্মরণ করলেন না কেউ। সীমাহীন কষ্টের বিষয় যে, তার সৃষ্ট কৃষকলীগও রীতিমত স্রোষ্টাকে বেমালুম ভুলে গেলো। এ ঘটনা একদিকে যেমন লজ্জ্বার, অন্যদিকে তার চে কষ্ট উপশমহীনতার। শুধু তাই নয়। এতদাঞ্চলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তনকারীও তিনি। অথচ আওয়ামী লীগও তাকে জন্ম মৃত্যুদিনেও স্মরণ করে না।
বর্তমান প্রজন্মও ভুলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার বাদল রশীদের অসামান্য অবদান। আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত রামদিয়া গ্রামে ১৯২৯ সালের এ দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। পিতা রুস্তম আলী বিশ্বাস ছিলেন তৎকালীন কোলকাতা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বাদল রশীদ ১৯৫২ সালে লন্ডন গমণ করেন বার-এ্যাট-ল পড়তে। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডনের লিংকস ইন কলেজ থেকে বার-এ্যাট-ল পাস করেন। এ সময় থেকেই তিনি তার সহজাত নেতৃত্বদানের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। লন্ডনে তিনি কলেজে পড়ুয়া বিভিন্ন দেশের সতীর্থদের নিয়ে গঠন করেন “ব্যাক টু দ্যা ভিলেজ” নামের সংগঠন।
ব্যাক টু দ্যা ভিলেজঃ সাম্রাজ্যবাদের স্বর্গভূমি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে তরুণ বয়সেই তিনি যে আদর্শের মন্ত্রবীজ অস্তিত্বে ধারণ করেছিলেন, শেষ বয়সে গ্রামে বসবাসের মধ্যদিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সৌম্যকান্তি-হাস্যোজ্জ্বল চেহারার তৎকালীন সময়ের উচ্চ শিক্ষিত (বিলাত ফেরত) যুবকের গ্রামে বসবাস কেউই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতেন না। ফলে অনেকেই তাকে “ধা’পো ব্যারিস্টার” বা “ মেঠো ব্যারিস্টার” বলে কটূক্তি করতেন। তার সাদামাটা জীবন- যাপন ছিলো কৌতুহল উদ্দীপক। বাড়ির সামনে ঘাসের উপর তার সাথে বসে কত সরকারি কর্মকর্তাকে আলোচনা করতে দেখেছেন অনেকে। তিনি গ্রামের কৃষকদের কল্যাণে “সাপ্তাহিক কৃষক” নামে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
যেভাবে তিনি নেতৃত্বের পাদপ্রদীপের নিচে আসেন: ১৯৬১/৬২ সালের ঘটনা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিন্ড মার্শাল আয়ুব খান লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দুতাবাস ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক। নির্ধারিত সময়ে ঘটল এক অঘটন। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির চেয়ারে এক বাঙালি ছাত্র হঠাৎ এসে বসে পড়েন। এতে প্রচ- অপমানিত হন আয়ুব খান। অথচ নাটকীয়ভাবে এঘটনার মধ্যদিয়ে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্র উম্মোচিত হয় ব্যারিস্টার বাদল রশীদের সামনে। তিনি সহজেই “হিরো ইমেজ” গড়ে তুলতে সমর্থ হন। অল্প সময়েই দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের কানেও এ তথ্য পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। তিনি তরুণ বাঙালি সমাজের সেনসেশন ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে ডেকে নেন রাজনৈতিক কর্মকা-ে। এরপর ১৯৬৩ সালে ব্যারিস্টারি পাস করার পরে দেশে ফিরলে তিনি ওই ঘটনায় আটক হন। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তাকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠান। ১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান: তারপর আসে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা ‘৭১ সাল। সে সময়ে প্রবাসী সরকারের তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল লিয়াজো অফিসার ও প্রবাসী সরকার প্রধান তাজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী। তার অফিস ছিলো কলিকাতা ৫১ নম্বর প্রিন্সেস স্ট্রীট।
মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তার ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করতে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি অল ইন্ডিয়া ডক ইয়ার্ড শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি কুলকি নায়ারের মাধ্যমে আমেরিকার ডক ইযার্ড শ্রমিকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কীভাবে আমেরিকা থেকে যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান মানবতা বিরোধী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ডক ইয়ার্ড শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে তৎকালীন আমেরিকান সরকার নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েন। সেকারণে আমেরিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধের সহযোগিতা করতে পাকিস্তানে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে পারেনি। সপ্তম নৌবহর এসে পৌঁছুলে মুক্তিযুদ্ধের কত বেশি ক্ষতি হতো তা সহজেই অনুমেয়। তিনি লন্ডন শহরে অবস্থিত তার একমাত্র বাড়িটিও জনমত গঠনের কাজে ব্যবহার করতেন। তার লন্ডনের “বাংলাদেশ হাউজ” নামের বাড়িটি প্রবাসী সরকারকে দান করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ওই বাংলাদেশ হাউজটি বাংলাদেশ দুতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তিতে বাড়িটি “পুরাতন হয়ে গেছে এই অজুহাতে বিক্রি করে দেয়া হয়। মরহুম সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমšী¿ থাকাকালে বাড়িটি বিক্রি করা হয়।
সাংস্কৃতিক দূত: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ছাড়াও তিনি প্রবাসী সরকারের আর্থিক তহবিল গঠনে নামেন। তিনি “বিক্ষুদ্ধ বাংলাদেশ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে মুম্বাইসহ ভারতের সকল বড় বড় শহরে অনুষ্ঠান করেন। তৎকালীন শান্তিনিকেতনের উপাচার্য’র সহযোগিতায় আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, সরদার আলাউদ্দিন, নমিতা ঘোষ, মকছেদ আলী শাহসহ ভারতের নামিদামী বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে তার অবদান: ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার বাদল রশীদের অনস্বীকার্য অবদানের কথা প্রায় সকলের অজানা অধ্যায়। প্রবাসী সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট যখন বার বার ধর্ণা দিয়েও বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিতে পারছিলেন না। তখন ব্যারিস্টার বাদল রশীদ দিল্লীর জামে মসজিদের প্রধান ঈমাম সাহেবকে বুঝিয়ে তাকে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিকট সুপারিশ করান। তার সুপারিশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন ইন্দিরা গান্ধী।
কৃষকলীগ প্রতিষ্ঠা: কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু বাদল রশীদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৭২ সালে আজকের দিনে বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু প্রতিষ্ঠাই করেননি, কৃষকলীগকে সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠার কাজও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্পন্ন করেছিলেন। কৃষকদের জন্য তিনিই দেশে প্রথম স্বতন্ত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেন। আজীবন কৃষকদের স্বজন হয়ে তাদের সাথেই তার ছিলো যাপিত জীবন।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে তিনি এমপি এবং ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালের ২৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন। ছোট পরিসরে এ বিরাট কীর্তিমানের সম্পর্কে লেখতে চাওয়া অনেকটা অমার্জনীয় অপরাধ।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৫ খ-, আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিচিতি গ্রন্থ, চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস, দেশি-বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ ও প্রকাশিত সাক্ষাৎকার।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More