মেহেরপুরের হতভাগ্য একজন রানারের কথা

মহাসিন আলী, মেহেরপুর: মেঘে মেঘে বেলা শেষ। বয়স পার করেছি ৮৪ বছর। স্বাধীনতার ৪ বছর আগে থেকে ডাক বিভাগের রানারের কাজ করছি। দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধও করেছি। ভেবেছিলাম স্বাধীন দেশে চিঠির ব্যাগ টেনে ভালো পারিশ্রমিক পাবো। চিন্তাও করিনি মুক্তিযুদ্ধ করে ভাতা পাওয়া যাবে। তবে আমার কপালে নেই; তাই পায়নি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ যোগাতে আর এ বয়সে দুজনের দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য আজও সাইকেলে করে ডাক বয়ে বেড়াচ্ছি। মাঝে এক সময় রেশন ছিলো। চাল-ডাল, আটা-চিনি, তেল-লবন খুবই কম দামে পেতাম। তাও জিয়া সরকারের আমলে কেড়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের দেয়া চারটি হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে চলতে হয় কোনোভাবে। কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ রানার ইউনুচ আলী।

ইউনুচ আলী মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের গোভীপুর গ্রামের মাঝপাড়ার মৃত ফকির মোহাম্মদের ছেলে। তিনি ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। ৮ ছেলে-মেয়ের বিয়ের পর তারা পাখির মতো বাসা ছেড়ে উড়াল দিয়েছে। ভাঙা বাসায় অসুস্থ স্ত্রী রহিমা খাতুনকে নিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছেন। এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা পাশে নেই। তাই অসুস্থ হলেও কষ্ট করে মেহেরপুর প্রধান ডাকঘর থেকে চিঠির বস্তা নিয়ে সাইকেল ঠেলে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় তাকে। তিনি আরও বলেন, চাকরী জীবনের প্রথম দিকে অন্যান্য বিভাগের চাকরীজীবীদের মত মাত্র ২৫ টাকা বেতন আর রেশন তুলে চাকরি করেছি। আজও ওই চাকরি করছি। তবে অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাগ্য বদল হলেও আমাদের ভাগ্য বদল হয়নি।

জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, মেহেরপুরের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা তিনি। ভারতের বেতাই হতে অস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছেন তিনি। কাইয়ূম চৌধুরীর অধীনে তিনি কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর আবারও চিঠির ব্যাগ ঘাড়ে তুলে নিয়ে রানানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ৫৪ বছরের চাকরি জীবনে তার বেতন ৪ হাজার টাকা মাত্র। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হননি তিনি। বর্তমানে তার স্ত্রী রহিমা খাতুন প্রেসার, অ্যাজমা ও হার্টের রোগ নিয়ে অসুস্থ। তিনি নিজেও চোখে কম দেখছেন। তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, অল্প বেতনে একমাসে দুবেলা খাব কি? আর নিজেদেরই চিকিৎসা করাবো কি দিয়ে ? এরপর চাকরী শেষে কি খেয়ে বাঁচবো?

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘর সূত্রে জানা যায়, জেলার ৩ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ৩১টি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিস আছে। যেখানে একজন করে ইডিএ (অতিরিক্ত বিভাগীয় সহকারী) পোস্ট মাস্টার, চিঠি বিলিকারী ও রানার রয়েছেন। মাসিক সম্মানী হিসেবে পোস্ট মাস্টার ৪৪৬০ টাকা, চিঠি বিলিকারী ৪৩৫৪ টাকা ও রানার ৪১৭৭ টাকা করে পেয়ে থাকেন। এছাড়া পোস্ট অফিস পরিচালনার জন্য মাসিক সর্বোচ্চ মাত্র ২৫ টাকা ও সর্বনি¤œ মাত্র ৫ টাকা করে দেয়া হয়।

মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মাসুদ হোসেন বলেন, গ্রাম-গঞ্জে ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের গুরুত্ব আজও কম নয়। প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি অফিসের চিঠি, ব্যাংক-বীমার চিঠি ও বিয়ের তালাক নামাসহ বিভিন্ন ধরণের চিঠিপত্র এ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়ে থাকে। জেলার কয়েকটি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের রানার না থাকায় পোস্ট মাস্টারকে সরকারি গাড়িতে ডাক তুলে দেয়ার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এছাড়া কোনোকোন ব্রাঞ্চে বিলিকারী না থাকায় পোস্টমাস্টার নিজেই গ্রাহকের হাতে চিঠি পৌঁছে দিয়ে থাকেন। আর কাজের ক্ষেত্রে এ ব্রাঞ্চের তিনজন কর্মচারীর গুরুত্ব কম নয়। তাই আমাদের তিনটি পদে বেতন/সম্মানী বৃদ্ধিতে সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার আব্দুল মোমিন বলেন,  ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসগুলোতে আগের মত কাজ নেই। তারপরও প্রত্যেক ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসে প্রতি মাসে প্রায় ১৩ হাজার টাকা সম্মনী দেয়া লাগে। তবে তিনি তাদের দাবির প্রতি সমর্থন করে বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাদের ভাতা বৃদ্ধি করা জরুরী।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More