বেচাবিক্রি না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে চুয়াডাঙ্গার গরু খামারিদের : পুঁজি টেকানোই কঠিন

জহির রায়হান সোহাগ: করোনা ভাইরাস ম্লান করেছে চুয়াডাঙ্গার নিয়মিত ও মরসুমি গরু খামারিদের স্বপ্ন। বৈশ্বিক এ মহামারীর কারণে ছেদ পড়েছে পশু কেনাবেচায়। বেচাবিক্রি না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে চুয়াডাঙ্গার গরু খামারিদের। লোকসানের শঙ্কায় আতঙ্কে রয়েছেন খামারিরা। এখন আসল দাম ফিরে পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খামারিদের। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু মোটাতাজা করে বিপাকে পড়েছেন তারা। জেলার পশুর হাটগুলো জমে উঠলেও আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় হাট থেকে গরু বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতারা। গরু বেচাকেনার জন্য অনলাইন বাজার ব্যবস্থা চালু করেছে জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। কিন্তু প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাতেও আগ্রহ নেই গ্রাম্য খামারিদের।
গরু বেচাবিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকা এমনই এক গরু খামারি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দত্তাইল গ্রামের রনজু আহমেদ। ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশের পর হয়নি সরকারি চাকরি। পরে আর চাকরির দিকে না ঝুঁকে শুরু করেন গরুর খামার। তার খামারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গরু ‘শাহেন শাহ’। এটি জেলার সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় গরুও বটে। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে লালন পালন করা প্রায় ৩০ মণ ওজনের গরুটির দাম ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতারা আসছেন ‘শাহেন শাহ’কে দেখতে।
খামারি রনজু আহমেদ জানান, তার খুব শখের গরু ‘শাহেন শাহ’। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে লালন পালন করা ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটির ওজন প্রায় ৩০ মণ। গরুটির অন্তত ১৮ মণ মাংস হবে। এর দাম ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। জেলার হাটগুলোতে গরুটি নিয়ে গিয়ে আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় আবার বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার সবচেয়ে বড় গরু ‘শাহেন শাহ’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘শাহেন শাহ’র দাম ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হাকাচ্ছেন ঢাকা, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ক্রেতারা। ২০ লাখ টাকার গরু ৫ লাখে বিক্রি করলে খুব লোকসান হবে। গরুর আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে বলেও জানান এ খামারি।
রনজু আহমেদের মতো একই অবস্থা চুয়াডাঙ্গার অন্যান্য গরু খামারিদের। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু মোটাতাজা করে সঠিক দাম না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। ক্রেতা বিক্রেতাদের সুবিধার্থে গরু বেচাকেনার জন্য অনলাইন বাজার ব্যবস্থা চালু করেছে জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। কিন্তু প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাতে খুব একটা আগ্রহ নেই গ্রাম্য খামারিদের। করোনার সংক্রমণের মধ্যেও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবাধে গরু ঢুকছে বলে অভিযোগ অনেক খামারিদের।
দামুড়হুদার জুড়ানপুর গ্রামের খামারি আছির উদ্দিন জানান, তার খামারে বিভিন্ন জাতের ৩৮টি গরু রয়েছে। গত ১ বছর ধরে গরু মোটাতাজা করে সম্প্রতি হাটে নিয়ে হতাশ হয়েছেন তিনি। যে গরুর দাম ২ লাখ টাকা সেই গরুর দাম ১ লাখ টাকা বলছেন ব্যাপারিরা। তাই গরু বিক্রি না করে আবার খামারে ফিরিতে আনতে হয়েছে। অনলাইন বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা গ্রামের মানুষ। অনলাইন বাজার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আমাদের কেউ ওই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়নি।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এবার চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলায় কোরবানি ঈদ উপলক্ষে দেড় লক্ষাধিক পশু লালন পালন করছেন ৭ হাজার ৩৩৭ জন খামারি। এরমধ্যে গরু ৩৮ হাজার ৬৯৭টি এবং ছাগল ও অন্যান্য পশু ১ লাখ ১১ হাজার ৫১৫টি। স্থানীয় চাহিদা রয়েছে ৬৮ হাজার গরু, মোষ ও ছাগলের। এরমধ্যে ১৮ হাজার গরু ও মোষ ও ৫০ হাজার ছাগল। উদ্বৃত্ত ২০ হাজার গরু, মোষ ও ৬০ হাজার ছাগল বাইরের জেলায় বেচাবিক্রি করবেন খামারিরা। কোরবানি ঈদ উপলক্ষে খামারিদের লালন পালন করা ১ লাখ ৫০ হাজার ২১২টি পশুর দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৪৯৯ কোটি টাকা।
করোনার প্রাদুর্ভাব থাকলেও তা উপেক্ষা করে জমে উঠেছে জেলার ৪টি বড় সদর উপজেলার নয়মাইল, দামুড়হুদা উপজেলার ডুগডুগি, জীবননগরের শিয়ালমারী ও আলমডাঙ্গার পৌর পশুহাটসহ সবগুলো পশুহাট। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এসব হাটে ঘোরাফেরা করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। পশুহাটে আসা ক্রেতা বিক্রেতারা মাস্ক পরিধান না করায় বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা।
সদর উপজেলার নয়মাইল পশুহাটে গরু বিক্রি করতে আসেন নেহালপুরের জামিল হোসেন। তিনি জানান, করোনার কারণে নেই গরুর দাম। একটি গরু গত বছর ১ লাখ টাকা দিয়ে কিনে লালন পালন করে সেই গরু ৫০ হাজার টাকা দাম বলছেন ক্রেতারা। গত ১ বছর থেকে গরু পুঁষে এখন আসল দামই উঠছে না। কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় হাট থেকে গরু বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতারা।
করোনার সংক্রমণরোধে ক্রেতা বিক্রেতাদের পশুহাটে যেতে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে অনলাইনে পশু কেনাবেচার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এএইচএম শামিমুজ্জামান। তিনি আরও জানান, দেশীয় পদ্ধতিতে গরু হৃষ্টপুষ্ঠ করতে সকল খামারিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সদর উপজেলার দত্তাইল গ্রামের রনজু আহমেদের গরুটি জেলার সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় গরু। পশুবেচা কেনার জন্য ‘অনলাইন পশু হাট’ নামে একটি ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে। এখানে জেলার খামারিরা তাদের গরু, ছাগলের ছবি, বর্ণনা, সম্ভাব্য দাম, যোগাযোগের জন্য ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করছেন। তবে, ‘অনলাইন পশুহাট’ এখনও তেমন একটা সাঁড়া মেলেনি। ঈদের আগ মুহূর্তে অনলাইন ভিত্তিক বেচাবিক্রি বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। এদিকে, ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধভাবে গরু আসা বন্ধে সীমান্তে তদারকি বাড়ানোর দাবি জানান জেলার খামারিরা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More