ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনায় ইসরাইলের ভয়াবহ হামলা সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ ২০ সিনিয়র কমান্ডার ও ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীসহ নিহত ৭৮

স্টাফ রিপোটৃার: মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের রাজধানী তেহরানে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাকে মূল লক্ষ্যবস্তু করে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইরানের স্থানীয় সময় ভোর ৪টার দিকে তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ভোর পর্যন্ত হামলা অব্যাহত ছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এত বড় হামলা দেখেনি ইরানের নাগরিকরা। ইরানের ১০০ স্থাপনার ওপর হামলায় ইসরাইল ২০০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ ২০ জন সিনিয়র কমান্ডার ও ছয় জন পরমাণু বিজ্ঞানীর প্রাণ গেছে। হামলায় মোট প্রাণ গেছে ৭৮ জনের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ। সেখানে গতকাল দ্বিতীয় বার হামলা চালানো হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল নেতানিয়াহুর সরকার। ইরান শতাধিক ড্রোন দিয়ে হামলা করলেও ইসরাইল সেগুলো ভূপাতিত করেছে। ইরানে হামলার পরই বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যায়।
ইরানে সবচেয়ে বড় হামলা: আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বৃহস্পতিবার ইরানে ইসরাইল হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছিল। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে গতকাল ইরানের স্থানীয় সময় ভোর ৪টার দিকে ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনা এবং শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। দেশটি বলেছে, এ অভিযান চলমান থাকবে এবং আরো অনেক অর্জন বাকি আছে। তেহরান, আশপাশের এলাকা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম পরিশোধনাগারের কাছে বিস্ফোরণের তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পালটাপালটি হামলা দেখা গেলেও ইরানের মাটিতে এমন সরাসরি সামরিক অভিযান ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এবারই প্রথম। ইরানে ইসরাইলি হামলার এই সময়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কাল রবিবার ওমানের মাস্কটে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ বলছে, ইসরাইলি হামলায় দেশটিতে ৭৮ জন নিহত এবং ৩২৯ জন আহত হয়েছে।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের যুদ্ধবিমান ‘অসংখ্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে আছে ইরানের বিভিন্ন এলাকার পরমাণু স্থাপনা।’ ২০০টি যুদ্ধবিমান প্রায় ১০০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরাইল। ইরানের সরকারি টিভি চ্যানেল জানিয়েছে, ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শহরের পূর্বাঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। এসব জায়গায় আগুন ও ধোঁয়া দেখা গেছে এবং বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। আবাসিক ভবনের ক্ষয়ক্ষতি বেসামরিক মানুষ হতাহতের তথ্যও জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলটি আরো জানায়, ইরানের ইসপাহান প্রদেশের কেন্দ্রে অবস্থিত নাতানজ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র লক্ষ্য করে বেশ কয়েক বার হামলা চালানো হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে পরমাণু স্থাপনাটি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে দ্বিতীয় বারের মতো সেখানে হামলা চালানো হয়েছে বলে ইসরাইলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বাধা দিতে ইসরাইল ইরানে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নাম দিয়ে যে হামলা চালিয়েছে, তাতে ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ মোট ২০ জন কমান্ডার নিহত হয়েছেন। যাদের নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিতভাবে পাওয়া গেছে, তারা হলেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার ঘোলামালি রশীদ এবং আইআরজিসির বিমান বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ। এছাড়া ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শীর্ষ উপদেষ্টা আলি শামখানিও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন।
অন্তত ছয় জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইরান। তাদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত নাম ফেরেয়দুন আব্বাসি, যিনি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এইওআই-এর সাবেক প্রধান ছিলেন। এছাড়া নিহত হয়েছেন মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি। তিনি ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তেহরানের ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই তালিকায় আরো আছেন আব্দোলহামিদ মিনৌচেহর, আহমাদ রেজা জোলফাঘারি ও আমিরহোসেইন ফেকহি। এদের প্রত্যেকেই তেহরানের শহিদ বেহেশতি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। ষষ্ঠ জনের পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি। শুধু তার পদবি ‘মোতাল্লেবিজাদেহ’ উল্লেখ করা হয়েছে। হামলার পরপরই তেহরানের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, হামলায় আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শিশুদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ইসরাইলের দিকে ছোঁড়া সব ইরানি ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। দেশটির হোম ফ্রন্ট কমান্ড, যারা এর আগে আশ্রয়কেন্দ্র সংক্রান্ত সতর্কতা জারি করেছিল। তারা জনগণকে জানিয়েছে যে, এখন আর কারোর আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে অবস্থান করার প্রয়োজন নেই। তবে একই সঙ্গে সকলকে সতর্ক ও সজাগ থাকার কথাও বলা হয়েছে। ইসরাইলিরা ইরানের হামলার ভয়ে খাবার পানি এবং শুকনো খাবার সংগ্রহ ও মজুত করছেন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে কয়েক দফায় পরিচালিত হামলা অত্যন্ত সফল হয়েছে। নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দেন, ইরানের বিরুদ্ধে বড় আকারের সামরিক অভিযানের শুরুতে এটা ছিল প্রথম পর্যায়ের হামলা। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, আমরা প্রাথমিক হামলা চালিয়েছি, যা খুবই সফল হয়েছে এবং ঈশ্বরের সহায়তায় আমরা আরো অনেক কিছু অর্জন করব। নেতানিয়াহু বলেন, এই হামলা ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। ‘যতদিন প্রয়োজন, ততদিন এ আক্রমণ অব্যাহত থাকবে। ইরানে হামলার পরপরই নিজ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ইসরাইলি সরকার। এদিকে ইরানে ইসরাইলি হামলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি বলেছেন যে, এই হামলা ইসরাইলের বর্বর স্বভাবের প্রমাণ। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে আরো বলেন, এই হামলার মাধ্যমে ইসরাইল নিজেই নিজের জন্য একটি করুণ পরিণতির পথ তৈরি করেছে, যার ফলাফল তারা নিশ্চিতভাবেই ভোগ করবে।
ইরানের ওপর হামলার পরপরই ইসরাইল, ইরান, জর্ডান ও ইরাক চার দেশই তাদের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করে এবং সব ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করা হয়। ফ্লাইট ট্র্যাকিং সাইট ফ্লাইটরেডার২৪ এর ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় যে, এই দেশগুলোর আকাশ এখন পুরোপুরি ফাঁকা, একটি ফ্লাইটও চলাচল করছে না। এদিকে, এয়ার ফ্রান্স জানিয়েছে যে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তেল আবিবে আসা-যাওয়ার সকল ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। হামলার পর ফ্রান্স জানিয়েছে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। ইরানের পরমাণু অস্ত্রের কর্মসূচি থেকে সরে আসতে হবে। সৌদি আরব ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছে। তবে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জানিয়েছেন, ইরান মার্কিন কোনো স্থাপনায় হামলা চালালে আরো কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। মার্কিন কর্মকর্তাদের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানকে মোকাবিলায় এসব সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে। তুরস্ক হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More