স্কুলে স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করল দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া স্কুলে স্মার্টফোন ও স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আইন আকারে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

বুধবার জাতীয় পরিষদে বিলটি পাশ হয় ১৬৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১১৫ জনের সমর্থনে। আইনটি কার্যকর হবে ২০২৬ সালের মার্চ থেকে।

বুধবার (২৭ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে টিআরটি গ্লোবাল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্মার্টফোন আসক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ব্যবহার শিক্ষার মান, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এর আগে ফ্রান্স ও ফিনল্যান্ড আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, মূলত কম বয়সী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও চীন তুলনামূলকভাবে কঠোর বিধিনিষেধ চালু করেছে। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যে স্কুলের সব স্তরে ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। নেদারল্যান্ডসে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলে ফোন নিষিদ্ধের পর শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বেড়েছে।

শিক্ষকদের হাতে ক্ষমতা

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন আইন অনুযায়ী, শিক্ষকরা শুধু ক্লাসে নয়, স্কুল প্রাঙ্গণের যেকোনো জায়গায় ফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবেন। জরুরি অবস্থা ও শিক্ষামূলক কাজেও ছাড় দেওয়া হবে।

‘গবেষণা ও চিকিৎসা প্রমাণ দেখাচ্ছে, স্মার্টফোন আসক্তি শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও মানসিক বৃদ্ধিতে মারাত্মক ক্ষতি করছে,’ বলেছেন বিলটি প্রস্তাব করা বিরোধী দলের সংসদ সদস্য চো জুং-হুন। তিনি আরও জানান, বিশ্বজুড়ে এরকম উদাহরণ বাড়ছে বলেই দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যও এটি জরুরি ছিল।

সরকারি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় ৪৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোন নির্ভরশীল — যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। দেশটি বিশ্বের অন্যতম ডিজিটালি সংযুক্ত দেশ; পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, ২০২২–২০২৩ সালে ৯৯% দক্ষিণ কোরিয়ান অনলাইনে এবং ৯৮% স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। কিশোরদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি জানিয়েছে, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া

অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক নতুন আইনের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে পারবে।

‘স্কুলে গেলে পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুত্ব গড়ে তোলার কথা, নানা কাজে অংশ নেওয়ার কথা। কিন্তু ফোনের কারণে তারা মনোযোগ দিতে পারছে না,’ বলেছেন সিউলের এক ১৪ বছরের শিক্ষার্থীর মা চোই ইউন-ইয়ং। আরেক অভিভাবক কিম সান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের মধ্যে ভয়ঙ্কর মাত্রায় গালিগালাজ ও সাইবারবুলিং চলছে।

শিক্ষক সমাজও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে। রক্ষণশীল কোরিয়ান ফেডারেশন অব টিচার্স’ অ্যাসোসিয়েশন আইনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছে, এতে শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় আরও শক্ত ভিত্তি মিলবে। সংগঠনটির এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০% শিক্ষক ফোন ব্যবহারের কারণে সমস্যা অনুভব করেছেন। এমনকি নিয়ম কার্যকর করতে গিয়ে কেউ কেউ মৌখিক বা শারীরিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

তবে প্রগতিশীল কোরিয়ান টিচার্স অ্যান্ড এডুকেশনাল ওয়ার্কার্স’ ইউনিয়ন কোনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেয়নি। তাদের কিছু সদস্য মনে করেন, আইনটি শিক্ষার্থীদের অধিকার সীমিত করতে পারে এবং আসল সমস্যা যেমন অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে অগ্রাহ্য করছে।

শিক্ষার্থীদের দ্বিধা

সব শিক্ষার্থী তবে এ নিষেধাজ্ঞাকে সমাধান হিসেবে দেখছে না। ‘শুধু ফোন কেড়ে নেওয়াই সমাধান নয়। আগে শেখাতে হবে ফোন ছাড়া কীভাবে সময় ব্যবহার করা যায়,’ বলেছেন ১৮ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থী সিও মিন-জুন। তার মতে, স্কুলে নিষেধাজ্ঞা দিলেও স্কুলের বাইরে স্ক্রিন টাইম কমবে না।

অন্যদিকে, ১৩ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, কোচিং ও হোমওয়ার্কে ভরা ব্যস্ত সূচির কারণে ফোনে আসক্ত হওয়ার সময়ই তার নেই।

দক্ষিণ কোরিয়া এই আইন কার্যকরের মাধ্যমে স্কুলে স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করা কয়েকটি দেশের দলে যোগ দিল। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এতে কি সত্যিই কিশোরদের প্রযুক্তি নির্ভরতা কমবে, নাকি সমস্যার মূল কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More