শবে বরাত অর্থ কি?

........................... প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী .................................

শবে বরাত : ফজিলত করণীয় ও বর্জনীয়
ফারসি ‘শব’ অর্থ রাত, আর আরবি ‘বারাআত’ অর্থ মুক্তি। সুতরাং শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী । হিজরি ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’ মাস। এই শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য মানুষকে মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। এ কারণে এই রাতকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনী বলা হয়।
শবে বরাতের ফজিলত: শবেবরাতকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত । তারা এ রাতকে উপলক্ষ্য বানিয়ে নানা অনৈসলামিক কাজকর্ম ও রসম-রেওয়াজে থাকে ব্যস্ত। হক্কানি ওলামায়ে কেরাম সবসময়ই এসবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনও করছেন। ইদানিং আবার এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা। তাদের দাবি হলো, ‘ইসলামে শবেবরাত বলে কিছু নেই। এ বিষয়ে যতো রেওয়ায়েত আছে সব মওযু অথবা যয়িফ। তাই এসব রেওয়ায়েত অনুযায়ী আমল করা এবং শবেবরাতকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ রাত মনে করা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ।’ বাস্তব কথা হলো, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়িও যেমন সঠিক নয়, তেমনি আবার ছাড়াছাড়িও সঠিক নয়। শবেবরাত সম্পর্কে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো, এ রাতের ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত বা জামায়াতের কোনো রূপ না দিয়ে, ওয়াজিব, ফরজের মত গুরুত্ব প্রদান না করে এবং এ রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন বিশিষ্ট সাহাবি মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ এই হাদিস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের ঘোষণা হয় তখন তার অর্থই এই হয় যে, এই সময়ে এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যতœবান হতে হবে, যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের উপযুক্ত হওয়া যায়। আর ওইসব গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে, যার কারণে মানুষ আল্লাহ তায়ালার রহমত ও মাগফেরাত থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু উপরোক্ত হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফেরাতের ঘোষণা আছে, তাই এ রাতটি অনেক আগে থেকেই শবেবরাত তথা ‘মুক্তির রজনী’ নামে প্রসিদ্ধ। কেন না, এ রাতে গোনাহ থেকে ও গোনাহর অশুভ পরিণাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি শবেবরাতের ফজিলতের বিষয়ে দ্বিতীয় কোনো হাদিস নাও থাকতো, তাহলেও এই হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। অথচ হাদিসের কিতাবগুলোতে নির্ভরযোগ্য সনদে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার আল্লাহর রসুল (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গলি নড়লো। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিলো, আপনি ইন্তেকাল করেছেন কি না। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রসুলই ভালো জানেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন ‘এটা হলো অর্ধ-শাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (বাইহাকি ৩/৩৮২-৩৬৮)।
শবে বরাত ও হালুয়া রুটি: শবে বরাতের সঙ্গে হালুয়া রুটির একটি প্রচলন আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যায়। হালুয়া আরবি শব্দ, অর্থ হলো মিষ্টি বা মিষ্টান্ন। রাসুলুল্লাহ (স.) মিষ্টি পছন্দ করতেন, এ কথা সুবিদিত; তিনি গোশতো পছন্দ করতেন, তা-ও অবিদিত নয়। যা-ই হোক শবে বরাত হলো ইবাদতের রাত। দান-খয়রাত করা ও মানুষকে খাওয়ানো এক প্রকার ইবাদত যা যে কোনো সময়ে করা যায়। তবে এই রাতকে হালুয়া রুটির রাতে পরিণত করে ইবাদত থেকে গাফেল হওয়া চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।
শবে বরাতে করণীয়: নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ সেজদায় দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। এছাড়াও যে সমস্ত আমল করা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১) কুরআন তেলাওয়াত করা, ২) দরুদ শরীফ পড়া, ৩) ইস্তেগফার করা, ৪) দোয়া করা, ৫) পরের দিন রোজা রাখা, ৬) নফল নামাজ যেমন, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ ও ছলাতুল হাজত পড়া, ৭) দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আযকার ইত্যাদি করা, ৮) কবর জিয়ারত করা ও ৯) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে দোয়া করা।
শবে বরাতে বর্জনীয়: শবে বরাতে যা যা করা উচিত নয়: (১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো, লাইটিং করা (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা, (৩) শরিয়ত বিরোধী আনন্দ-উল্লাস করা, (৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, (৫) অন্য কারো ইবাদতের বা ঘুমের বিঘœ ঘটানো, (৬) সুন্নত মনে করে হালুয়া রুটি বিতরণ করা ও (৭) জামায়াত আকারে কোন নফল নামাজ পড়া শুধুমাত্র শবে বরাত নয়, গোটা শাবান মাসটাই বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূণ মাস। এ মাস রমজানের প্রস্তুতির মাস। হাদিসের ভাষ্য অনুসারে, রসুলুল্লাহ (স.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত করতেন এবং রোজা রাখতেন। রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের নফল রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিহ হাদিসে আয়িশা (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (স.) কে আমি শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে এতো অধিক নফল রোজা পালন করতে দেখিনি। তিনি যেন গোটা শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। তিনি সামান্য (কয়টি দিন) ব্যতীত গোটা শাবান মাস রোজা রাখতেন (সহিহ মুসলিম)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শবে বরাতের বরকত দান করেন এবং আমাদের সমুদয় পাপ মাফ করে দেন। আমীন।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More