অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ১ এর কার্যালয় ভাঙচুর : অনির্দিষ্টকালের জন্য আইনজীবীদের আদালত বর্জন

চুয়াডাঙ্গায় জেলা জজ আদালতের নতুন নাজির নিয়োগকে কেন্দ্র করে আদালত কর্মচারীদের সাথে আইনজীবীদের বিরোধ

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় জেলা জজ আদালতের নতুন নাজির নিয়োগকে কেন্দ্র করে আদালত কর্মচারীদের সাথে আইনজীবীদের তুমুল হট্টগোল হয়েছে। এরই জেরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ১ এর (ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ) কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘটেছে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ আদালতে এসব ঘটনা ঘটে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আদালত চত্বরে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. বজলুর রহমান এবং দুই কর্মচারীকে জেলা থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আদালত বর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি। সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যকরী সদস্যদের লাঞ্ছিত ও কয়েকজনকে মারধরের ঘটনায় এ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়।
জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান অবসরজনিত ছুটিতে যান। ওই দিন তিনি এক বদলি আদেশে বর্তমান নাজির মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামানকে সরিয়ে জেলা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী নুরুল হককে নাজির হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে আদেশ জারি করেন। বদলির আদেশের পর দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে নুরুল হক ও মাসুদুজ্জামানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে নতুন নাজির নুরুল হক দায়িত্ব গ্রহণের বিষয় নিয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বজলুর রহমানের কাছে আইনজীবীদের সাথে করে নিয়ে যান। বিজ্ঞ আদালতও বদলি আদেশ দেখে সন্দেহ প্রকাশ করে অমান্য করেন। এসময় আইনজীবীদের সাথে বিচারকের মতপার্থক্য তৈরি হলে সেখানে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আদালতের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিচারকের কার্যালয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজের কার্যালয়ের টেবিল ভাঙচুর করা হয়। আইনজীবীরা ওই টেবিল ভাঙচুর করেন বলে জজশিপের কর্মচারীদের অভিযোগ। এসময় আদালতের সকল কর্মচারী ছুটে এসে প্রতিবাদ জানালে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। পরে আইনজীবীর এক সহকারীকে আটকের খবরে আবারও উত্তপ্ত হয় আদালত প্রাঙ্গণ। আইনজীবীরাও লাঠিসোঁটা ও বাঁশ নিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন। এসময় পুলিশ তাদেরকে শান্ত করে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কনক কুমার দাস, সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খানসহ জেলা পুলিশের একাধিক টিম। ঘটনাস্থলে এসে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় জেলা পুলিশের একাধিক টিম। আদালতের পরিবেশ শান্ত রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার পর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামান জানান, ‘সকালে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান স্বাক্ষরিত একটি ভুয়া বদলির আদেশ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বজলুর রহমানের কাছে যান আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর হোসেনসহ ১০-১৫ জন আইনজীবী। তারা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বজলুর রহমানকে আদেশটি মানার জন্য বলেন। ভুয়া আদেশ না মানায় ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বজলুর রহমানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে টেবিল ভাঙচুর করেন আইনজীবীরা। পরে আদালতের কর্মচারীরা এসে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজকে হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করেন।’ তিনি আরও জানান, ‘চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান যোগদানের পর থেকে আমার কাছ থেকে দফতরের ও আমার ব্যক্তিগত মোট ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে খরচ করেন। প্রতিদিন তিনি ফার্নিচার ক্রয়সহ ব্যক্তিগত খরচ বাবদ ওই টাকা নিয়েছেন। টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বদলির হুমকি দেন। গত ১৫ মার্চ বেলা ৫টায় চার্জ হস্তান্তর করে অবসরজনিত ছুটিতে যান চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান। কিন্তু ওই দিন রাত ১টার দিকে আমাকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জেলা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী নুরুল হককে নতুন নাজিরের দায়িত্ব দিয়ে একটি ভুয়া আদেশ জারি করেন।’ জেলা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী নুরুল হক জানান, ‘সদ্য বিদায়ী জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান ১৫ মার্চ চাকরি থেকে অবসর নেন। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আদালতের বিচারক মো. বজলুর রহমান ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পান। শেষ কর্ম দিবসে তিনি জেলা জজ আদালতের নাজির মাসুদুজ্জামানকে অনুলিপি শাখার প্রধান তুলনা সহকারী পদে বদলি এবং প্রেষণে রেকর্ডকিপার হিসেবে দায়িত্ব দেন। সেই সাথে আমাকে জেলা জজ আদালতের নতুন নাজির পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু মো. মাসুদুজ্জামান গত চার দিনেও আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালতে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বিষয়টি সুরাহা করতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালিম হাসানসহ কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের খাসকামরায় যান। বিচারকের সামনেই মাসুদুজ্জামান, জহুরুল ইসলামসহ আদালতের কর্মচারীরা আইনজীবীদের লাঞ্ছিত করেন।
এদিকে আইনজীবীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আগামী রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা আইনজীবী সমিতির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আলমগীর হোসেন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচি ঘোষণাকালে সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালিম হোসেনসহ সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। জরুরি সাধারণসভায় সাবেক সভাপতি সেলিম উদ্দিন খান, নুরুল ইসলাম, এমএম শাহজাহান মুকুল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম রফিউর রহমান, সিনিয়র আইনজীবী মসলেম উদ্দিন, মাহতাব হোসেন, মারুফ সরোয়ার বাবু, আকসিজুল ইসলাম রতন, ফজলে রাব্বী সাগর ও মানি খন্দকার বক্তব্য রাখেন।
সভায় আইনজীবীরা বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জেলার বাইরে বদলি না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বিচারপতি দিয়ে তদন্ত করা হবে। ক্রিকেটের স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আইনজীবী নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ জহুরল ইসলামের শহরে ৪-৫টা বাড়ি আছে, মাছের ঘের আছে ও প্রচুর জমি করেছেন তিনি। বিষয়টা দুদককে জানানো হবে। ব্যাংকে ৪-৫ কোটি টাকা আছে। দুর্নীতিবাজ মাসুদ ও জহুরুলকে গ্রেফতার করতে হবে। এর আগে বেলা ১১টায় জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জরুরি সাধারণসভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্মচারী দুজন হলেন জেলা জজ আদালতের নাজির মো. মাসুদুজ্জামান এবং জীবননগর সহকারী জজ আদালতের সেরেস্তা সহকারী জহুরুল ইসলাম।
আইনজীবীরা জানান, সদ্য বিদায়ী জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হাসান গত ১৫ মার্চ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ মো. বজলুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে যান। শেষ কর্ম দিবসে তিনি জেলা জজ আদালতের নাজির মো. মাসুদুজ্জামানকে অনুলিপি শাখার প্রধান তুলনা সহকারী পদে বদলি এবং প্রেষণে রেকর্ডকিপার হিসেবে দায়িত্ব দেন। সেই সাথে জেলা জজ আদালতের পেশকার (বেঞ্চ সহকারী) নুরুল হককে নাজির পদে নিয়োগ প্রদান করেন। মো. মাসুদুজ্জামান গত চার দিনেও নুরুল হককে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালতে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
বিষয়টি সুরাহা করতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক তালিম হোসেনসহ কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা আদালত পরিচালনার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. বজলুর রহমানের সাথে দেখা করতে খাসকামরায় যান। ওই সময় বিচারকের সামনেই মাসুদুজ্জামান ও জহুরুল ইসলামসহ আদালতের কর্মচারীরা লাঠিসোঁঠা নিয়ে আইনজীবীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসলাম উদ্দিন ও কার্যনির্বাহী সদস্য সাজ্জাদ হোসেন রকি এ হামলায় আহত হন। খবর পেয়ে সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লুৎফুল কবীরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং আইনজীবীদেরকে উদ্ধার করেন। এসব ঘটনার প্রতিবাদে জেলা আইনজীবী সমিতি বেলা ১১টায় বিশেষ জরুরি সাধারণসভার আয়োজন করে। সভা চলাকালে সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খান সেখানে যান এবং আইনজীবীদেরকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান। এ বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. আলমগীর হোসেন জানান, নতুন নাজির নিয়োগের বিষয়ে আমরা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের কাছে গেলে তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেন। এতে আমাদের ৪-৫ জন আইনজীবী আহত হন। এ ঘটনার পর দুপুরে জেলা আইনজীবী সমিতির এক জরুরিসভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় জেলা ও দায়রা জজ ১ আদালতের বিচারক ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ বজলুর রহমান, নাজির মাসুদুজ্জামান ও বেঞ্চ সহকারী জহুরুল ইসলামের অপসারণের দাবি জানানো হয়। তিনি আরও জানান, এ হামলার ঘটনায় মামলা করা হবে। বিষয়টি প্রধান বিচারপতি এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More