আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড ক্লিনিকে সিজারের সময় ভুঁড়ি বের হয়ে নবজাতকের মৃত্যু

সার্জন না হয়েও অবৈধ ক্লিনিকের মালিক নাজমুল হক নিজেই করেন সকল রোগীর অপারেশন

স্টাফ রিপোর্টার: প্রসূতির সিজার করতে গিয়ে নবজাতকের ভুঁড়ি বের করে দেয়া হয়েছে। আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে। প্রসূতি বেঁচে গেলেও সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতক একদিন পর মারা গেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে সিজার করার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে রোগীর লোকজনের অভিযোগ। প্রসূতি ওই ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকলেও সদ্যভূমিষ্ঠ নবজাতককে নেয়া হয়েছে নিজবাড়ি উপজেলার মাজু গ্রামে। ইউনাটেড মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক ভুল অপারেশনের অভিযোগ আছে। এমনকি কয়েকবার ক্লিনিকটি বন্ধের নির্দেশও দেয় কর্তৃপক্ষ। তারপরও অবৈধভাবে ক্লিনিকটি চালিয়ে আসছে কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার মাজু গ্রামের সাগর আলীর স্ত্রী রুমা খাতুনের প্রসব বেদনা উঠলে তাকে গত শুক্রবার আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। দুপুরে প্রসূতির সিজার করা হয়। রুমা খাতুনের স্বামী সাগর আলী বলেন, সিজার অপারেশন করার সময় নবজাতকের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। ওই অবস্থায় আমার সন্তানকে না দেখিয়ে গোপন কক্ষে ৩ ঘন্টা রেখে দেয়। এরপর তার মায়ের কাছে দেয়া হয়। ভূমিষ্ঠের পর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার কারণে সন্তানের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। রাতে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়। আমার সন্তানকে কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক। পরে আমার সন্তানকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসি।

সাগরের ফুফাতো ভাই উজ্জ্বল হোসেন জানান, শনিবার বিকেলে বাড়ি থেকে নবজাতককে আবারও আমরা কুষ্টিয়া সনো সেন্টারে নিয়ে যাই। সেখানে যাওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তিনি আরও জানান, আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের মালিক নাজমুল হক নিজেই অপারেশন করেছিলেন। তবে শর্ত অনুযায়ী একজন বিশেষজ্ঞ সার্জনকে দিয়ে সিজার করানোর কথা ছিলো। তারা এটা করলে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতো না।

এ ব্যাপারে ইউনাইটেড ক্লিনিকের মালিক উপসহকারী মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক বলেন, প্রসূতির অপারেশন করেছেন ডা. বিপাশা। জন্মের সময় ত্রুটির কারণে শিশুর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসে। এটা ডাক্তারের ত্রুটি নয়। এখানে কারও কিছু করার ছিলো না। পোস্টমর্টেম করলেই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। পুলিশকেও আমি একই কথা বলেছি।

তবে সাগর আলী বলেছেন, জন্মের সময় কোনো ত্রুটি থাকলে তো আল্ট্রাসনোগ্রামে দেখা যেতো। কিন্তু রিপোর্ট স্বাভাবিক ছিলো। এ ঘটনায় আলমডাঙ্গা থানার এসআই জামাল বলেন, এ ঘটনায় মারা যাওয়া শিশুর পিতা সাগর আলী বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এদিকে, এর আগেও ইউনাটেড মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ভুল অপারেশনে একাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় একাধিক সময়ে ক্লিনিকের সকল কার্যক্রম বন্ধেরও নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তারপরও তারা অবৈধভাবে ক্লিনিক ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো।

একাধিক অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৭ মার্চ অপারেশনের পর প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সকল কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গার তৎকালীর ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল হক তন্ময়ের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত টিম ওই ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। এর দুদিন আগে ৫ মার্চ কুষ্টিয়া মিরপুরের মালিহাদ ইউনিয়নের রায়পাড়া গ্রামের রহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা খাতুনের প্রসব বেদনা দেখা দিলে তাকে আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ক্লিনিক মালিক নাজমুল ডাক্তারের পরামর্শে রোগীকে রাত ৮টার দিকে অপারেশন করার পর একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু প্রসূতির প্রেসার বেড়ে গেলে তা কমানোর জন্য ইনজেকশন পুশ করা হলে রোগী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কুষ্টিয়ায় নেয়ার পর প্রসূতি ফাতেমাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তবে সেসময় রোগীর স্বজনরা বলেন, ক্লিনিকে ফাতেমার মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয় ক্লিনিকের লোকজন। এ ঘটনায় তারা লাশ নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে বিচার দাবি করেন। ঘটনাটি তদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল হক তন্ময়কে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই তদন্ত টিম ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক তদন্তে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেন।

২০১৮ সালের ১৯ জুলাই আলমডাঙ্গার ছোটপুটিমারি গ্রামের তানজেদ আলীর মেয়ে রোজিনার অপারেশন করেন ডা. বিডি দাস পিকলু। অপারেশনের তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে ২য় দফায় আবারও অপারেশন করা হয়। তাতেও সুস্থ না হয়ে তার অবস্থা আরও সঙ্কটজনক হয়। পরে রোজিনাকে রাজশাহী রেফার করা হয়।

এর কিছুদিন পরই ৩ আগস্ট ওই ক্লিনিকে অপারেশনের পরপরই ভুমিষ্ট শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রসূতিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। ওইদিন আলমডাঙ্গা বাবুপাড়ার সোহাগের স্ত্রী সিমা খাতুনের প্রসব বেদনা উঠলে নেয়া হয় ইউনাইটেড ক্লিনিকে। ওইরাতেই ডা. বিডি দাস পিকলু অপারেশন করলে কন্যা সন্তান প্র¯্রব করেন সিমা। এরপরই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে ভুমিষ্ঠ শিশু ও প্রসূতি। তাদের রাজশাহী মেডিকেলে রেফার করলে সেখানকার চিকিৎসক ভুমিষ্ঠ শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।

২০১৮ সালের ২৭ জুলাই আলমডাঙ্গার ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ক্লিনিকের বিভিন্ন কেবিন অপরিস্কার, রোগীদের পচা খাবার পরিবেশন করার অভিযোগে এ জরিমানা করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাহাত মান্নান।

২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারে বুদো জোয়ার্দ্দার (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান চৌধুরী চিকিৎসক না হয়েও রোগীর শরীরে ইনজেকশন দেয়ায় এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুল চিকিৎসায় বুদো জোয়ার্দ্দারের মৃত্যু হয়েছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তার স্বজন ও বিক্ষুব্ধ লোকেরা ওই ক্লিনিকে ভাঙচুর চালান। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সেসময় ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান চৌধুরী এবং ক্লিনিকের অংশীদার সাব্বির রহমানের বাবা সাইদুর রহমানকে (৫০) আটক করে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইউনাইটেড মেডিকেল সেন্টারের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় উপজেলা প্রশাসন।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More