গাংনীর টুটুল মুদি দোকানি থেকে শীর্ষ মানব পাচারকারী

তিনটি ওভারসিজের মালিক হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা
স্টাফ রিপোর্টার: সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল। বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামে। এইচএসসি পাস টুটুল একসময় ছিলেন মুদি দোকানদার। ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিনি। এক পর্যায়ে অধিক অর্থ আয়ের লোভে জড়িয়ে পড়েন মানব পাচারচক্রে। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতেন টুটুল। পরে নিজেই খোলেন তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠান। তবে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার ও শিক্ষিত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাচার করেন তিনি। হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তবে টুটুলের এ প্রতারণার কাজে অন্যতম সহযোগী মো. তৈয়ব আলী চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। এর আড়ালে টুটুলের মানব পাচার চক্রের সহায়তায় অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণ এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। তার সহযোগী ও স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেয়া মো. তৈয়ব আলী (৪৫) ছিলেন চা বিক্রেতা। মানব পাচার আর চাকরি দেয়ার নাম করে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। তারাসহ ৮ জনকে গ্রেফতারের পর বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তাদের সঙ্গে গ্রেফতার অন্যরা হলেন মেহেরপুরের মো. মারুফ হাসান (৩৭) ও লাল্টুু ইসলাম (২৮), কুষ্টিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন (৫৪) এবং মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), গোপালগঞ্জের শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), শরিয়তপুরের আলামিন হোসাইন (৩০)। ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবকের মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৪ ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড্ডা থানার লিংক রোডে টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে দুই নারীসহ ৪ ভিকটিমকে উদ্ধার, ১০টি পাসপোর্ট, ৭টি ফাইল, ৪টি সিল, ১৭টি মোবাইল, ৫টি রেজিস্টার, ব্যাংকের চেক বই, ২টি কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার টাকাসহ ওই আট মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএসসি পাস টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার বামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। লোভে পড়ে মানব পাচারকারী চক্রে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন। পরে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় খুলে বসেন টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামে তিনটি এজেন্সি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা প্রতারণামূলকভাবে গ্রহণ করেছেন টুটুল।
টুটুলের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী আবু তৈয়ব। পড়াশুনা না জানা তৈয়ব চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দিতেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। টুটুলের প্ররোচনায় চক্রে জড়িয়ে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে মানব পাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। অনেককে দিয়েছেন চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্রও। মানব পাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লাল্টু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পূর্ণ করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে আসছিলো।
ডিআইজি মোজাম্মেল হক আরও জানান, প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা টার্গেট করে দেশের বেকার ও অসচ্ছল যুবক-যুতীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে লোভনীয় বেতনে কাজ দেয়ার নাম করে প্রলুব্ধ করতো। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাত। টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসা-বাড়িতে কাজ করার নামে পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভুয়া রসিদ দিত। এ বাবদ প্রতিজনের কাজ থেকে দুই থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়া হতো। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চ শিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতেন।
অপরদিকে চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভিকটিমদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতো। এতে ভিকটিমদের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। পাসপোর্ট অফিসের দালালদের সঙ্গেও সখ্য ছিলো চক্রের সদস্যদের। কথিত মেডিকেল টেস্ট শেষে নারী ভিকটিমদের বাসা-বাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতো এই চক্রটি। পাচার হওয়া ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারতো না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরতে যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো। মোজাম্মেল হক বলেন, চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেপ্তার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করতেন। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে তৈয়ব।
বৈধতা না থাকার পরও কিভাবে মানব পাচার করেছিল টুটুল- তৈয়ব চক্র এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। প্রতারিত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হয়রানির অভিযোগ তুলে মানববন্ধন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈধ কোনো জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানব পাচার করতে না পারে সেজন্যই র‌্যাবের অভিযান।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More