চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবোশেখি ঝড় : গাইবান্ধা ও কুষ্টিয়ায় ১০ জন নিহত

ঘরবাড়ি গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে উৎসারিত কালবোশেখি ঝড়ে ল-ভ- দেশের বিভিন্ন এলাকা। প্রচ- ঝড়ো হাওয়া এবং সেই সঙ্গে ছিলো বজ্রপাত। বজ্রপাতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চারদিক। ভেঙে পড়ে গাছপালা ও ঘরবাড়ি। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুত খুঁটি উপড়ে পড়ে। ঝড়ের সময় বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ঝড়কবলিত এলাকাগুলো এসময় অন্ধকার হয়ে পড়ে। গাইবান্ধায় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী কালবোশেখি ঝড়ে ১০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই গাছের ডাল ভেঙে মারা গেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে রবিউল ইসলাম রবি (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। শেরপুরের শ্রীবরদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে একই পরিবারের তিনজন আহত হয়েছেন। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ঝড়ে উপড়ে পড়েছে গাছপালা। রাজশাহীর বাঘায় ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে আম ও ধানের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া রাজধানীতে শিশুসহ দুজন আহত হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় মোক্তারপুরে বজ্রপাতে দুজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) জানিয়েছে, রাজশাহী, রংপুর অঞ্চল থেকে দুপুরের পর কালবোশেখি ঝড়ের উদ্ভব ঘটে। কয়েকটি বজ মেঘ একত্র হয়ে তৈরি করে এই ঝড়। পরে তা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা এই ঝড় ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যায়। ঢাকার ওপর দিয়ে তা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে।
চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে বয়ে গেলো কালবোশেখি ঝড়। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৬টা থেকে সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত ঝড় বয়ে যায়। ঝড়ের আগে শহর এলাকায় অন্ধকার নেমে আসে। ঝড়ের পর যানবাহনগুলো হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করে। শহরের মধ্যে জন শূন্য হয়ে অনেকেই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। শহরের মধ্যে ঝড়ের দাপট ততোটা বোঝা না গেলেও শহরতলী ও গ্রামে গাছপালা ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোথাও হালকা বৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ের কারণে উঠতি ফসলের ক্ষেত, জৈষ্ঠ্য মাসের ফল আম, তরমুজ, বাঙ্গি, লিচু ও কাঁঠাল ফলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু কিছু এলাকার কাঁচা ঘরের টিনের চালা উড়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য মতে অর্ধশত ঘরের টিনের চালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষক আবু মুসা জানান, তার এলাকায় প্রচ- দমকা বাতাসের সাথে শিলাবৃষ্টি ঝড়ে গেছে। প্রায় আধাঘণ্টা ব্যাপী ঝড়ে বোরোর ফুলতে ধান শীষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছুকিছু এলাকায় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া মাঠে থাকা মরিচ, ভুট্টা ও গ্রীষ্মকালীন সবজির কিছু কিছু ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, ঝড় শুরু হওয়ার পূর্বের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে কিছু এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয়েছে। অনেক এলাকায় রাতে বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা সম্ভব হয়নি বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার মোক্তারপুরে বজ্রাপাতে স্বামী-স্ত্রী দুজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যার সময় মোক্তারপুর গ্রামের উম্বর আলী ও তার স্ত্রী রোকসনা খাতুন নিজ বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসময় বজ্র বাড়ির নারিকেল গাছে পড়লে তারা দুজন আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এসময় স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা টোকন খান জানান, সন্ধ্যায় বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতের সময় স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বজ তাদের নারকেল গাছের পড়লে তারা দুজনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেহেরপুরের গাংনীতে চৈত্র মাসে প্রথম ঝড় ও বজ্র-বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও ঝড় শুরু হয়। সন্ধ্যার পরপরই ঝড়ের পাশাপাশি বৃষ্টি এবং বজ্রপাত হয়। ফলে বিদ্যুত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের কারণে গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গাছের কিছু ডালপালা ভেঙে পড়ে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে রোববার বিকেল থেকে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিদ্যুত ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় রোগীদের কষ্টের শিকার হতে হয়। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটর থাকলেও রোগীদের গরমে ও অন্ধকারে কষ্ট করতে হচ্ছে।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ঝড়ের বাতাসে উড়ে আসা টিনের আঘাতে রবিউল ইসলাম রবি (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উপজেলার আল্লারদর্গা দফার ফিলিং স্টেশনের কাছে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রবিউল ইসলাম উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের শশীধরপুর গ্রামের সাদ ম-লের ছেলে। তিনি স্থানীয় বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
রবিউলের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিউল কুষ্টিয়া থেকে পেঁয়াজ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে ঝড়ের কবলে পড়লে আল্লারদর্গা বাজারের পাশে দফাদার ফিলিং স্টেশনের কাছে এসে আশ্রয় নেন। এসময় ঝড়ের প্রচ- বাতাসে পাশের চালা থেকে আচমকা একটি টিন এসে রবিউলের ঘাড়ের পেছনে আঘাত হানলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করলেও অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে ঘটনাস্থলেই মারা যান। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিলে সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেন।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গাইবান্ধায় প্রায় ঘন্টাব্যাপী কালবোশেখি ঝড়ে ১০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা সদরে চার, পলাশবাড়ীতে তিন, ফুলছড়িতে দুই ও সুন্দরগঞ্জে এক। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মতিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতরা হচ্ছেন গাইবান্ধা সদরের রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হরিণসিংগা গ্রামের হিরু মিয়ার ছেলে মুনির (৫), একই ইউনিয়নের আরিফ খান বাসুদেবপুর গ্রামের রিজু মিয়ার স্ত্রী আর্জিনা বেগম (২৮), পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমেদপুর গ্রামের আবদুল কাদের মিয়ার স্ত্রী মমতা বেগম (৬৪) ও ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ডাকাতিয়ার চর গ্রামের মৃত বারেক মিয়ার ছেলে হাফিজ উদ্দিন (৬৫)। এছাড়াও পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়নের বাকেরপাড়া গ্রামের ইউনুছ আলীর স্ত্রী জাহানারা বেগম (৫০) ও একই ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে আবদুল গফফার (৪২), গাইবান্ধা সদর উপজেলার মালিবাড়ী ইউনিয়নের ঢনঢনিপাড়া গ্রামের মিঠু মিয়ার স্ত্রী সাহারা বেগম (৪১) ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের কিশামত হলদিয়া গ্রামের সোলায়মান আলীর স্ত্রী ময়না বেগম (৪৭) এবং ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারি গ্রামের বিশু মিয়ার স্ত্রী শিমুলি বেগম (২৬)। এছাড়া ঝড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল রোববার বিকেল তিনটার দিকে হঠাৎ বৃষ্টিহীন কালবোশেখি ঝড় শুরু হয়। এসময় পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়নের ডাকেরপাড়া গ্রামের জাহানারা বেগম বাড়ির উঠানে সাংসারিক কাজ করছিলেন। এক পর্যায়ে বাড়ির একটি গাছ উপড়ে পড়ে। এতে গাছের নিচে চাপা পড়ে জাহানারা ঘটনাস্থলে মারা যান। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আবদুল গফফার মোস্তফাপুর বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি গাছ উপড়ে তার শরীরের ওপর পড়ে। এতে তিনি চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান।
জাহানারা বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন পলাশবাড়ী থানার ওসি মো. মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, বেলা সোয়া তিনটার দিকে কিশামত হলদিয়া গ্রামের ময়না বেগম বাড়ির আঙিনায় কাজ করছিলেন। এসময় বাড়ির একটি গাছ ভেঙে পড়লে তিনি এর নিচে চাপা পড়ে মারা যান। ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান গাছ চাপায় ওই নারী নিহত হবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ফুলছড়ি থানার ওসি কাওছার আলী মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন। গাইবান্ধা সদরের ঢনঢনি পাড়ার সাহারা বেগম ঝড় শুরু হলে খড়ি কুড়াতে বাড়ির উঠানে যান। এসময় গাছের ডাল তার মাথায় ভেঙে পড়ে। এতে তিনি মারা যান। এদিকে ঝড়ে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এছাড়াও ঝড়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে। তবে কি পরিমাণ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ইদ্রিশ আলী তাৎক্ষনিকভাবে তা জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, ঝড়ে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা জরিপ করে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More