জমি বন্ধক ও ঋণের টাকায় কেনা ইজিবাইক নিয়ে গেলো অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা

চুয়াডাঙ্গায় বেড়েছে চুরি-ছিনতাই; তৎপর অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা : অপরাধীদের ধরতে মাঠে পুলিশ

আফজালুল হক: দেড় মাস আগে ১০ কাঠা জমি বন্ধক রেখে ৭০ হাজার ও ব্র্যাক ব্যাংক থেকে আরও ১ লাখ টাকা লোন তুলে ছেলে মনিব হোসেনকে ইজিবাইক কিনে দেন পিতা মিলন হোসেন। ইজিবাইক চালিয়ে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করে আসছিলো ছেলে মুনিব হোসেন। গতকাল যাত্রী নিয়ে গেলে আলমডাঙ্গার হাউসপুরে মনিবকে অচেতন করে ইজিবাইক নিয়ে যায় যাত্রীবেশে পালিয়ে যায় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। চালক মনিব হোসেনকে (২১) রাস্তার একপাশে ফেলে রেখা যায় তারা। পরে স্থানীয়রা মনিবের নিকট থাকা মোবাইলের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে মনিবকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। ছেলের ইজিবাইক নেয়ার ঘটনা শুনে পিতা মিলন হোসেনকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। মনিব হোসেন চুয়াডাঙ্গা সদরের শঙ্করচন্দ্র গ্রামের মাঝেরপাড়ার মিলন হোসেনের ছেলে।

এদিকে চুয়াডাঙ্গায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে চুরি, অজ্ঞানপার্টি, ছিনতাইসহ নানান অপরাধ। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। হঠাৎ করেই চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। পুলিশ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখে অভিযুক্তদের সনাক্ত করতে পারলেও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না। তাদেরকে আটক করতে না পারায় তারা বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এখন পর্যন্ত অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের কাউকেই আটক করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ বলছে, বেশ কিছুদিন অজ্ঞানপার্টিসহ চুরি, ছিনতাই কমেছিলো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এখন আবারো বেড়েছে। গত মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা শহরের ডিজিটাল মোড়ের অদূরে কৌশলে শুভ (১৬) নামে এক কিশোরের মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। একটি মোটরসাইকেলযোগে দুজন যুবক কিশোরকে গতিরোধ করে মেয়েদের ছবি তোলার অভিযোগ তুলে কৌশলে মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়। সেখানে সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট অভিযুক্তদের দেখা যায়। যা সহজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অভিযুক্তদের নিকট পৌঁছানো সম্ভব বলে মনে করেন সচেতন মহল। একই কৌশলে মেয়েদের ছবি তোলার অভিযোগে একাধিক যুবকের মোবাইল হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। এরা জেলার বিভিন্নস্থানে মোটরসাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো পুলিশ পরিচয়ে কৌশলে গ্রাম-গঞ্জে, ব্যাংক, আদালতে বয়োবৃদ্ধ কিংবা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও কিছুদিন আগে শহরের সদর হাসপাতাল রোডের একটি কোচিং সেন্টার থেকে শিক্ষার্থীদের ৩টি সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার ডুগডুগি পশু হাটে যাওয়ার পথে ইখলাস নামে এক ব্যক্তি অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জের মৃত জলিলের ছেলে। পরিবারের অভিযোগ, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা তার নিকট থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে।  বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে চুয়াডাঙ্গা শহরের জিনতলা মল্লিকপাড়া থেকে কাজল (১৬) নামে এক কিশোরের ব্যাটারিচালিত পাখিভ্যানটি নিয়ে পালিয়ে যায় যাত্রীবেশি চোর। আয়ের একমাত্র সম্বল ভ্যান হারিয়ে এখন দিশেহারা এই কিশোর। যাত্রীদের অনুরোধে ভ্যান থামিয়ে ডিম আনতে গেলে কৌশলে কাজলের ভ্যান নিয়ে পালিয়ে যায় যাত্রীবেশী চোর। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ভ্যান না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কিশোর কাজল। ওইদিনই পুলিশ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্তকে আটক কিংবা ভ্যানটি উদ্ধার করতে পারেনি। গত ১৫ জানুয়ারি দুপুরে চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার পুরাতন গলির ভেতরে দিনদুপুরে চাকু ধরে এক নারী এনজিও কর্মীর গয়নাসহ নগদ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী নারী দাবি করেন, ওইদিন ১১টার দিকে ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার ৫শ টাকা তোলেন। এরপর মগ কেনার জন্য বড়বাজার পুরাতন গলির ক্রোকারিজের দোকানগুলোতে যান। সেখান থেকে তিনি আলিজা কোটেজ মিলের গলি হয়ে শহীদ আবুল কাশেম সড়কের উদ্দেশে রওনা হলে একজন পুরুষ পেছন থেকে চাকু ধরে। গলায় থাকা স্বর্নের চেন, কানে থাকা দুল, হাতের আঙুলে থাকা স্বর্নের দুটি আংটিসহ কাছে থাকা নগদ ১৪ হাজার ৫শ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক তদন্ত শুরু করে। বাজারের মধ্যে একটি দোকানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও দেখে ঘটনার সত্যতা পায় পুলিশ।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার সকালে আলমডাঙ্গার হাউসপুরে যাত্রীবেশে চালককে অচেতন করে ইজিবাইক নিয়ে পালিয়ে গেছে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। চালক মনিব হোসেনকে (২১) রাস্তার একপাশে ফেলে রেখা যায় তারা। পরে স্থানীয়রা মনিবের নিকটে থাকা মোবাইলের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা ঘটনাস্থলে পৌছে মনিবকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। মনিব হোসেন চুয়াডাঙ্গা সদরের শংকরচন্দ্র গ্রামের মাঝেরপাড়ার মিলন হোসেনের ছেলে। পিতা মিলন হোসেন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, দেড় মাস আগে নিজের ১০ কাঠা জমি বন্ধক রেখে ৭০ হাজার টাকা নিয়েছি। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে আরও ১ লাখ টাকা লোন তুলে ছেলের জন্য ইজিবাইক কিনে দিয়েছি। আজ (গতকাল) দুপুরে শুনছি ছেলেকে অচেতন করে ইজিবাইকটা নিয়ে গেছে। এই ইজিবাইক চালিয়ে প্রতিমাসে কিস্তির ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। আমি খুবই গরিব মানুষ, এখন কিভাবে পরিশোধ করবো টাকা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। হয়তো নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে অচেতন করেছিলো তারা। প্রশাসনের নিকট আমার ছেলের ইজিবাইকটা খুঁজে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। এদিকে চুয়াডাঙ্গায় অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টির অপতৎপরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাপ্তাহিক পশুর হাটের দিন বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে ছদ্মবেশে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ বলছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের চিহ্নিত করতে না পারায় তাদেরকে আইনের আওতায় নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার ভুক্তভোগীরাও আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। সচেতন হলেই অপরাধ অনেকটাই কমে যাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত সাপ্তাহিক পশুর হাটের দিনে গরু ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। যাত্রীবাহী বাস ও হাটের আশেপাশের খাবার হোটেলে থাকা ব্যবসায়ীদের কৌশলে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে হাতিয়ে নেয় টাকা। এতে ব্যবহার করা হয় চেতনানাশক ওষুধ, স্প্রে ও চেতনানাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য। কৌশলে এসব ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে অজ্ঞান করার পর সর্বস্ব লুটে নেয় তারা। এসব চক্রের কবলে পড়া লোকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হচ্ছেন। তবে শেষমেশ আইনের আশ্রয় নিচ্ছে না তারা। তাই চক্রের সদস্যদেরকে চিহ্নিত করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, চালককে অচেতন করে ইজিবাইক নিয়ে গেছে বলে জেনেছি। আমরা ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে অপরাধীদের সনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. আবু তারেক দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, পুলিশের তৎপরতার কারণে বেশি কিছুদিন চুরি, ছিনতাই, অজ্ঞানপার্টি খপ্পরে পড়ার ঘটনা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এখন আবারো বেড়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় নেয়ার জন্য। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, গতকাল আলমডাঙ্গার হাউসপুরে চালককে অচেতন করে ইজিবাইক নেয়ার ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা যেন সক্রিয় না হতে পারে এ জন্য যাত্রীবাহী বাসের চালক- হেলপারদের সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া পশুহাটে সচেতনামূলক পুলিশ মাইকিং কার্যক্রম অব্যাগত রয়েছে। গরু ব্যাবসায়ী কিংবা ক্রয়-বিক্রেতাদেরও আরও সতর্ক থাকতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তিদের দেয়া কোনো খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। একা একা না গিয়ে ৪-৫ জন এক সঙ্গে গেলে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা সুযোগ পেলেও টাকা নেয়ার চান্স খুবই কম।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More