জীবননগর ব্যুরো: চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহায়ক জীবননগর উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামের আব্দুল গাফফার ওরফে আকাশকে (২৫) চলন্ত কপোতাক্ষ ট্রেন থেকে পরিকল্পিতভাবে ফেলে দিয়ে হত্যার অভিযোগ তুলে সুষ্ঠু বিচারের দাবীতে কপোতাক্ষ ট্রেন অবরোধ করে মানববন্ধন করা হয়েছে। উথলী ইউনিয়নবাসী ও শোকার্ত পরিবারের ব্যানারে গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত উথলী রেলস্টেশনে দেড় ঘন্টাব্যাপী এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এসময় ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য ও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উথলী রেল স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। এ দিকে এ ঘটনায় ঐ দিনের কপোতাক্ষ ট্রেনের ঙ বগির ৫ জনের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, রবিবার সকাল হতেই সেনেরহুদা গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বিক্ষুদ্ধ লোকজন মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। খুলনা হতে রাজশাহীগামী আন্তঃনগর কপোতাক্ষ ট্রেনটি সকাল ৯টা ২০ মিনিটের সময় উথলী রেলস্টেশনে পৌঁছালে মানববন্ধনের কারণে ট্রেনটি আটকা পড়ে। পরে সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ এবং এলাকাবাসীর সহযোগীতায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর ট্রেনটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এ সময় আকাশ হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি বিক্ষুদ্ধ জনতার। বিক্ষুদ্ধ জনতা জানায়, দাবি পূরণ না হলে পরবর্তীতে তারা কঠোর অন্দোলনে যাবে। মানববন্ধনে উথলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, সেনেরহুদা জান্নাতুল খাদরা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক মহিউদ্দিন, নিহত আকাশের বাবা জিন্নাত আলী প্রমূখ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তারা বলেন, আকাশকে পরিকল্পিতভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। দ্রুত তদন্ত করে বিচার না করলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারী দেন বক্তাগণ। এ সময় কপোতাক্ষ ট্রেনের দায়িত্বে থাকা পরিচালক মাহবুবুর রহমানের হাতে একটি লিখিত অভিযোগ তুলে দেন তারা।
উল্লেখ, গত ২১ মে কপোতাক্ষ ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা থেকে বাড়ি ফেরার পথে জয়রামপুর আখ সেন্টারের নিকট রেল লাইনের পাশে পড়ে ছিলো শাথা থেঁতলানো ও ক্ষত-বিক্ষত গাফফার আলী ওরফে আকাশের (২৬) মরদেহ। আকাশ জীবননগর উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামের জিন্নাত আলীর একমাত্র ছেলে। সে চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাৎক্ষনিকভাবে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। পরদিন চুয়াডাঙ্গার সকল আঞ্চলিক পত্রিকাসহ জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার করা হয়। আকাশের মৃত্যুর কয়েকদিন পর মৃত্যুর ঘটনার নতুন মোড় নেয়। পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। পরিবারের দাবি, একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকা-কে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিইসহ রেলওয়ে পুলিশ ও এটেনডেন্টরা আকাশকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বলে নিহত আকাশের পিতা জিন্নাত আলী দাবী করেছেন। এ ঘটনায় নিহত আকাশের পিতা জিন্নাত আলী বাদি হয়ে গত ২১ মে ওই ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা ২ জন রেলওয়ে পুলিশ, ১ জন টিটিই এবং ২ জন এটেনডেন্টকে আসামি করে চুয়াডাঙ্গা আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
আসামিরা হলেন- ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিই লালন চক্রবর্তী (৪২), রেলওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পারভেজ (৩৬), কনস্টেবল কাদের (৪০), এটেনডেন্ট মিলন (৩৭) ও সোহাগ মিয়া (৩৬)।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গাফফার আলী আকাশ অফিস শেষে প্রতিদিনের মতো কপোতাক্ষ ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। ঘটনার দিন কপোতাক্ষ ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা টিটিই, রেলওয়ে পুলিশ ও এটেনডেন্টরা টিকিট না কেটে উঠা যাত্রীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছিলেন এবং তাদের কাছে অবৈধভাবে অনেক টাকা দাবি করছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় রেলওয়ে পুলিশসহ অন্যরা আকাশকে টেনে-হেঁচড়ে দরজার কাছে নিয়ে যায় এবং জয়রামপুর রেল স্টেশনের নিকট দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। এ মামলায় ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী স্বাক্ষীও প্রদান করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কপোতাক্ষ ট্রেনের একই বগিতে থাকা একাধিক যাত্রীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আকাশ হত্যার সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য আইনের আশ্রয় নিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবার। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষদর্শী এক যাত্রীর সাথে কথোপকথনের কল রেকর্ড হাতে পাওয়া গেছে। রেকর্ডে রাজশাহী থেকে ওঠা ওই ট্রেনের এক যাত্রী বলেছেন, আমরা ওই ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে ৭১ নং সিটে বসে ছিলাম। এক পর্যায়ে দেখতে পাই লাল গেঞ্জি পরিহিত একটা ছেলেকে (আকাশ) বগিতে দায়িত্ব থাকা কয়েকজন লোক টেনে হেঁচড়ে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছে নিয়ে যাওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ওই ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলেটার মাথা নিচের দিক দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। সেখানে দুইজন পুলিশ উপস্থিত ছিলো। তাদের সামনেই এই ঘটনা ঘটে।
কল রেকর্ডে আরও শোনা যায়, তারা দর্শনা হল্ট স্টেশনে নামার পর ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা কাদের নামের এক পুলিশের কাছে জানতে চায়, ছেলেটার অপরাধ কি ছিলো? পুলিশ কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়। আকাশের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন তার পিতা জিন্নাত আলী।
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.