তালাবদ্ধ বাড়ি থেকে ষাটোর্ধ্ব দম্পতির হাত-মুখ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের নৃশংসতা : হত্যার রহস্য উন্মোচনে মাঠে পিবিআই ও সিআইডি

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় তালাবদ্ধ বাড়ি থেকে ষাটোর্ধ্ব দম্পতির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলমডাঙ্গা পৌরসভার পুরোনো বাজার গিরিবাবুর মিলবাড়ির সামনের একটি বাড়ি থেকে ওই দম্পতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ব্যবসায়ী নজির আলী (৭০) ও তার স্ত্রী ফরিদা খাতুন (৬০)। নজির উদ্দিন চাল ব্যবসায়ী ও স্থানীয় শিলা সিনেমাহলের মালিক ছিলেন। গত শুক্রবার রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নজির আলী ও ফরিদা খাতুনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। শহরের ব্যস্ততম সড়কের পাশের ঘরে এভাবে বয়স্ক দম্পতি হত্যার রহস্য নিয়ে শহরে নানামুখি আলোচনা হচ্ছে। হত্যার রহস্য উন্মোচনে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে পিবিআই ও সিআইডি।
জানা যায়, নজির উদ্দীন ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকু-ু উপজেলার ধুলিয়া গ্রামের ছেলে। স্বাধীনতার পরেই তিনি আলমডাঙ্গা শহরে আসেন জীবিকার জন্য। এক সময় দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা মানুষ স্বপ্ন দেখতেন ধনাঢ্য হওয়ার। আলমডাঙ্গা শহরে আসার এক পর্যায়ে শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শিব নারায়ণ ভৌতিকার সাথে হৃদতা গড়ে তোলেন। বনে যান এ ধনাঢ্য অবাঙালির পোষ্যপুত্রে। এরই এক পর্যায়ে তিনি শিব নারায়ণ ভৌতিকার শহরের মূল্যবান জমি জাল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। শিব নারায়ণ ভৌতিকার প্রায় ৭০/৮০ কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে সরকারের সাথে মামলা চলছে। পরবর্তীতে নজির উদ্দীন, অসীত কুমারসহ অনেকেই সে জমি লিজ গ্রহণ করে নিজের দখলে রেখেছেন। নজির উদ্দীন এক সময় শিলা সিনেমাহল প্রতিষ্ঠিত করেন। যে বাড়িতে এ দম্পত্তি খুন হয়েছেন, সে বাড়িটি ছিলো প্রাক্তণ সেটেলমেন্ট অফিস ভবন। তিনি এ পোড়ো বাড়ি দখল করে লিজ নিয়েছেন। ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী হয়েও ব্যবহার অনুপযোগী এ বাড়িতেই তিনি সস্ত্রীক বসবাস করতেন। এসব কারণে তার চরিত্রের নেতিবাচক দিকটি বেশি আলোচিত হতো। জমিজমা সংক্রান্ত তাকে অনেকগুলো মামলা সামলাতে হতো।
পুলিশ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নজির আলী তার স্ত্রীসহ ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। শনিবার সকালে নজির আলীর স্বজনেরা বাড়িতে এসে দেখেন, বাড়ির বাইরে থেকে তালা দেয়া। পরে তারা জানালা দিয়ে দেখতে পান, ঘরের ভেতরে ফরিদা খাতুনের লাশ পড়ে আছে। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. স্বপন বেলা ১১টার দিকে মোবাইলফোনে থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শৌচাগার থেকে নজির আলীর লাশ ও কক্ষ থেকে ফরিদা খাতুনের লাশ উদ্ধার করেন।
আলমডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘তালা খোলার পর আলমডাঙ্গা থানার ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আমরাও ভেতরে প্রবেশ করি। এ সময় ঘরের ভেতরে ওই গৃহবধূর রক্তাক্ত লাশ ও ঘরসংলগ্ন শৌচাগার থেকে ব্যবসায়ীর লাশ দেখতে পাওয়া যায়। উভয়ের গলা থেকে মাথা পর্যন্ত ওড়নাজাতীয় কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো।’
নিহত দম্পতির জামাতা ওয়াহেদুজ্জামান পুলিশকে জানিয়েছেন, তার শ্বশুরের সঙ্গে জমি নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে বিরোধ চলে আসছিল। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাত থেকে নিহত দম্পতির জামাই অহিদুজ্জামান লিন্টুসহ পরিবারের সদস্যরা তাদের ফোন করে না পেয়ে বাড়িতে এসে তালাবদ্ধ দেখতে পান। পরে আমাদের জানালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা তালা ভেঙে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেন। তিনি আরও বলেন, গোসলখানা থেকে বৃদ্ধের হাত বাঁধা ও ঘরের মধ্যে থেকে বৃদ্ধার রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়। বৃদ্ধার পাশে পড়ে ছিলো ছোটকাঁচি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত করা হয়েছে বলে মনে। সিআইডিকে খবর দেয়ার পর তারাও এসেছে। ময়নাতদন্তের পর দ্রুত হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে হলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, নিহত ফরিদা খাতুন বেগমের শ্বাসনালী ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। নিহত নজিরের গলায় ও বুকে ৬টি ক্ষত ছিল। তাদের দুজনারই হাত-পা বাঁধা ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এতো ব্যস্ততম সড়কে অবস্থিত ঘরে ঢুকে দম্পতি হত্যাকা- নিয়ে সকলের মাঝে ঔৎসুক্য ছিলো। পার্শ্ববর্তী ভূষিমালের দোকানের সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেযে দেখা গেছে যে, রাত ১১টার পরে শ্রমিক শ্রেণির একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি দৌঁড়ে সড়ক দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তার পেছন পেছন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা ৫ জন উঠতি বয়সি তরুণ চলে গেছেন।
এ নৃশংস হত্যাকা- ঘিরে এলাকাবাসীর মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের মনে ৪টি সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
প্রথমত: নিহত নজীর উদ্দীন ব্যবসা করতেন নগদ টাকায়। তিনি সহজে ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। সম্প্রতি তিনি প্রায় ৪০ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছেন। সেই টাকা ঘরেই রেখেছেন। এমন বদ্ধমূল ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো চক্র চুরি কিংবা ডাকাতি করতে গিয়ে এ হত্যাকা- সংঘটিত করতে পারে। কিন্তু নিহত ফরিদা খাতুন বেগমের হাতের সোনার বালা খুলে না নেয়ায় এ সন্দেহ অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত: স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, নিহত নজির উদ্দীন এক সময় শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বর্গীয় শিব নারায়ণ ভৌতিকার পোষ্যপুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শিব নারায়ণের অপার স্নেহ লাভের পর নিহত নজির উদ্দীন তার মূল্যবান সম্পত্তি জাল দলিল করে নেন। ক্ষুব্ধ শিব নারায়ণ নজিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলা চলমান। পরবর্তিতে নজির উদ্দিন ও তার প্রতিবেশী ব্যবসায়ী অসীত কুমারসহ বেশকিছু সংখ্যক মানুষ শিব নারায়ণের সাথে সরকারের যে জমি নিয়ে মামলা চলমান; সেই জমি লিজও নিয়েছেন। নজির উদ্দীন, অসীত কুমারসহ বেশকিছু ব্যক্তি শহরের মূল্যবান জমি নিজের দখলে নিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের অন্তদ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকা- ঘটতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
তৃতীয়ত: শিব নারায়ণ ভৌতিকার সাথে জমি নিয়ে নজির-অসীত সিন্ডিকেটের দীর্ঘদিনের বিরোধ। এই সিন্ডিকেটের ভেতর নজির উদ্দীনের বয়স সবচে বেশি। সত্তরোর্ধ্ব। ইদানিং প্রচ- অসুস্থও। তাই নজির উদ্দীনকে হত্যা করে সহজেই স্বর্গীয় শিব নারায়ণ ভৌতিকার একমাত্র ছেলের ওপর চাপানো গেলে তিনি আর ভারত থেকে দেশে ফিরতে পারবেন না। ফলে সহজেই মোটা অংকের টাকার সম্পত্তি নির্বিঘেœ ভোগদখল করতে পারবেন সিন্ডিকেটটি। এ সন্দেহ পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
চতুর্থত: নিহত নজির উদ্দীনের একমাত্র বেকার জামাইও সন্দেহের বাইরে নয়। নানা মুখে আলোচনা শোনা যায়।
চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ করছে পুলিশের একাধিক টিম। তবে হত্যাকা-ের কারণ প্রাথমিকভাবে এখনও জানা যায়নি। তাদেরকে হত্যা করে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। নজির উদ্দিনকে শৌচাগারের ভেতর হাত-পা বেঁধে ও তার স্ত্রীকে ঘরের মেঝেতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করা হয়েছে। রহস্য উন্মোচনে পিবিআই ও সিআইডি টিমও কাজ করছে। ঘটনাস্থলে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তারেক, আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের, ডিবি, পিবিআই, সিআইডি, র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More