দর্শনা কেরুজ হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন বন্ধে ষড়যন্ত্র

নেপথ্যে নামিদামি ওষুধ কোম্পানি : উৎপাদন অব্যাহত রাখার দাবি কর্তৃপক্ষের

নজরুল ইসলাম: বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবে যখন সকলের কপালে ভাজ পড়েছে; ঠিক তখনি দর্শনা কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ মানব সেবায় তৈরি করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। কেরুজ চিনিকলের হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে যায় দেশব্যাপী। চাহিদা মোতাবেক মালমাল সরবরাহ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। মুনাফা অর্জন না সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানবতার সেবায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই যখন দর্শনা কেরুজ চিনিকলের হ্যান্ড স্যানিটাজারের বাজার অবস্থা; ঠিক তখনি চিনিকলের ওষুধ বিভাগ যেভাবে ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করা হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই এ পণ্যটি বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে দেশের কিছু নামিদামি ওষুধ কোম্পানি। গুণগত মান এবং বাজারমূল্য তুলনামূলক কম হওয়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। তবে কেরুজ চিনকল কর্তৃপক্ষের অভিমত মানুষের কল্যাণে যেটা একবার শুরু করা হয়েছে, তা যেন কোনোভাবেই কুচক্রিমহল বন্ধ না করতে পারে, সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট নিজের স্বার্থ না, দেশের স্বার্থে চালু থাকে তার জন্য জোরালো আবেদন জানানো হবে।
দর্শনা কেরুজ চিনিকলটি জেলার একমাত্র অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৮২ বছর ধরে। রাষ্ট্রায়াত্ত যতো চিনিশিল্প কারখানা আছে তার মধ্যে দর্শনা কেরুজ চিনিকল অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠন। যা বাংলাদেশ কেরু অ্যান্ড কোম্পানি নামে পরিচালিত। বাংলাদেশ চিনিও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের আওতায় এটি পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্রান্ডের অ্যালকোহল তৈরি হয়ে থােেক। যা দেশ ও দেশের বাহিরে সমাধ্রিত। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের জীবাণু ধ্বংসে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। ঘনঘন সাবান বা হ্যান্ড ওয়াস দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যা ব্যবহার করে হাত এবং মুখ নিরাপদ রাখা। বর্তমান প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করে দর্শনা কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ এক মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করে। কয়েক দিনের নিজেস্ব গবেষণায় নিজেদের উৎপাদিত ইথাইনল এবং ডিস্ট্রিল ওয়াটার ও গ্লিসারিন এবং রঙ ব্যবহার করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯৯ ভাগ জীবাণু মুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিও করে ফেলে কর্তপক্ষ। যার মধ্যে ৭০ ভাগ ইথাইনাল, ২৫ ভাগ ডিস্ট্রিল ওয়ার্টার, ২ ভাগ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আর ৩ ভাগ রঙ, গ্লিসারিন এবং ফ্লেবার রয়েছে। আর এটি সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ১শ মি.লি বোতল ৬০ টাকা খুচরা মূল্য এবং ৫০ টাকা পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করে দেন।
একটি সূত্র জানায়, দর্শনা কেরুজ চিনিকলে এক সময় উৎপাদিত হতো কয়েক প্রকার ওষুধ। যার মান এবং কার্যকারিতা ছিলো দেশ সেরা এবং মূল্যও ছিলো খুবই কম। কেরুজ চিনিকলের উৎপাদিত ওষুধ বাজারে দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পেছনে লাগে দেশের ওষুধ প্রশাসনসহ নামিদামি ওষুধ কোম্পানি। ষড়যন্ত্রে সফলতাও মেলে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি না মেলায় ২০০৩ সালে বাধ্য হয়ে ওষুধ বিভাগটি বন্ধ করে দিতে হয় চিনিকল কর্তৃপক্ষকে। এখানে প্রায় ১২০ প্রকার বিভিন্ন ধরণের ওষুধ তৈরি হতো। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে চিনিকলের উৎপাদিত হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাজার দখল করে ফেলেতে পারে এ আশঙ্কায় নামিদামি ওষুধ কোম্পানিগুলো দেশের ওষুধ প্রশাসনের কানের গোড়ায়মন্ত্র দিতে শুরু করেছে। যাতে করে ওষুধের মতো আইনের মারপ্যাচে ফেলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া যায়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে বর্তমান বাজারে বিক্রি হওয়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মধ্যে আছে মেসার্স এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৫০ মি:লি; বোতলের মূল্য ৪০ টাকা, মেসার্স অ্যাডভান্স কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫০ মি:লি: বোতলের মূল্য ১শ টাকা, মেসার্স ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৫০ মি:লি’র মূল্য ৪০ টাকা, মেসার্স জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৫০ মি:লি: বোতলের দাম ৪০ টাকা, গ্রীনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৫০ মি:লি বোতলের মূল্য ৪০ টাকা, স্কায়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৫০ মি:লি বোতলের মূল্য ৪০ টাকা ও অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস লি. ৫০ গ্রাম বোতলের মূল্য ৩১.২২ টাকা। সেই হিসাবে কেরুজ ১০০ মি.লি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পায়কারি মূল্য ৫০ টাকা।
উল্লেখ্য, ইথাইল অ্যালকোহল এটি এক প্রকারের অ্যালকোহল। এটি দাহ্য, স্বাদবিহীন, বর্ণহীন, সামান্য বিষাক্ত ও বিশিষ্ট গন্ধযুক্ত, এবং অধিকাংশ মদ এর প্রধান উপাদান। এতে ৯৯.৯৭% বিশুদ্ধ অ্যালকোহল। এটি জৈব সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। ইথানল একটি সামান্য চরিত্রগত গন্ধ সঙ্গে একটি অস্থায়ী, জ্বলন্ত বর্ণহীন তরল। এটি একটি সাইকোঅ্যাক্টিভ পদার্থ এবং মদ্যপ পানীয় পাওয়া প্রধান অ্যালকোহল। ইথানল স্বাভাবিকভাবেই পেট্রেমিক্যাল প্রসেসের মাধ্যমে চিনির শোষক দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং এটি সর্বাধিক জনপ্রিয় বিনোদনমূলক ড্রাগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি এন্টিসেপটিক এবং কীটনাশক হিসেবে ওষুধ অ্যাপ্লিকেশন আছে। ব্যাপকভাবে একটি রাসায়নিক দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বৈজ্ঞানিক রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য অথবা অন্যান্য জৈব যৌগগুলোর সংশ্লেষণের জন্য এবং এটি একটি কার্যকর পদার্থ যা বিভিন্ন ধরণের উৎপাদন শিল্পের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। ইথানল একটি পরিষ্কার-জ্বালানি উৎস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে তাকে। রসায়নের পরিভাষায় অ্যালকোহল বলতে একটি রাসায়নিক পদার্থের গ্রুপকে বোঝালেও প্রচলিত অর্থে সাধারণ মানুষ অ্যালকোহল বলতে ইথানলকে বোঝায়। প্রাকৃতিক উৎস ইস্টের মেটাবলিক প্রোসেসে উপজাত হিসেবে ইথানল পাওয়া যায়। তাই যেখানে ইস্ট পাওয়া যাবে সেখানে ইথানল অবশ্যই পাওয়া যাবে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড একটি প্রাথমিক চিকিৎসা উপকরণ যা প্রায় সবার ঘরেই থাকে। পানির সাথে অক্সিজেনের অতিরিক্ত অণু যোগ করেই তৈরি হয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। সংক্রমণ নাশক হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, বিষাক্ত পদার্থ দূর করে এবং জীবাণু ধ্বংস করে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের সচিব (চলতি দায়িত্ব) আবদুল ওয়াহাব বলেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন কেউ ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করতে পারবে না। বিষয়টি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত তদারকি করছে। কি কারণে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ হয়েছে সেটি আমার জানা নেই। তবে দেশের এই সংকটময় সময়ে মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পারা অবশ্যই গৌরবের। সব ভালো কাজের পেছনে কারো না কারো ষড়যন্ত্র সব সময় ছিলো এবং থাকবে। তাই বলে পিছু হটা যাবে না। চিনিকলের নবাগত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানব কল্যাণে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা হচ্ছে। ভালো কিছুর পেছনে যে কারো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। তাই বলে ষড়যন্ত্রের কাছে কল্যাণকর কাজ বন্ধ হতে পারে না। চিনিকল কর্তৃপক্ষ যে লাভবান হচ্ছে না ঠিক তা না। সীমিত আকারে হলেও তো মুনাফা অর্জন করছে। একদিকে মানব সেবা অন্য দিকে চিনিকলের মুনাফা সব মিলিয়ে যাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন কোনোভাবেই বন্ধ না হয় তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব যখন স্থম্ভিত; সেখানে স্বল্পমূল্যের এ পণ্যটি বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করে কেউ সফল হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
উল্লেখ্য, চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৫ মার্চ হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ মার্চ বাজারজাত শুরু করে। প্রথম দিকে বোতল সংকটে চাহিদা মোতাবেক মালামাল সরবরাহ করতে না পারায় লিটার ধরে বিক্রি শুরু করে। সরকারি-বেসরকারিভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ হ্যান্ড স্যানিটাজার উৎপাদন করেছে ২৭ হাজার ১৮১ লিটার, বিক্রি করেছে ২৩ হাজার ১৭০ লিটার বর্তমানে, মজুদ আছে ৩ হাজার ৩১২ লিটার। যার বিক্রি মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে উৎপাদন খরচ বাদ দিলে হিসাব হবে লাভ্যংশের।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More