দামুড়হুদার গোবিন্দহুদার বিশ্ব শান্তি আশ্রম এবং মঙ্গল সাধু

হাবিবুর রহমান: সাপের সঙ্গে বসবাস করেন মঙ্গল সাধু। তার আশ্রমে আছে নানা জীবজন্তু। পাখির অভয়ারণ্য এই আশ্রম। মঙ্গল সাধুর আশ্রমের নাম বিশ্ব শান্তি আশ্রম। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এই আশ্রমে বসবাস করছেন তিনি। মাটির গর্তে ধ্যান করেছেন টানা ৮ বছর। আর গাছের মাচায় থেকেছেন আরও ৮ বছর। তার এই দীর্ঘ তপস্যা এক আল্লাহকে পাওয়ার। মঙ্গল সাধু বলেছেন সাবধান! মাটি কাউকে ছাড় দেবে না। মাটির সাথে আট বছরের বসবাসে মাটির আচরণ তিনি টের পেয়েছেন। তাই তিনি আল্লাহর আরাধনা করতে বলেছেন। মঙ্গল সাধু বলেন নামাজ-রোজা কারোর জন্য মাফ নেই। নামাজ-রোজা বাদ দিলে মৃত্যুর পর মাটি কোনো ছাড় দেবে না। মাটি সব সময় গর্জন দিচ্ছে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন না করলে মাটি তোমাকে কঠিন শাস্তি দেবে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার গোবিন্দহুদা গ্রামের এক পাশে বাউলপন্থি সাধক মঙ্গল সাধুর বিশ্ব শান্তি আশ্রম। এই আশ্রমে শুধু মানুষই শান্তি খোঁজে না। শান্তি খুঁজে পায় পশু-পাখি কীট-পতঙ্গেরাও। আছে নানা প্রজাতির সাপ। তাদের জন্য নির্ধারিত জায়গা আছে আশ্রমে। ওরা কারোর ক্ষতি করে না। যার যেখানে জায়গা, সে সেখানেই অবস্থান করে। প্রায় ৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা বিশ্ব শান্তি আশ্রমে দু’দ- শান্তি খুঁজতে অনেক ভক্ত সেখানে যান। যান অনেক সাধারণ মানুষও। গোবিন্দহুদা গ্রামের ওলি মল্লিক ও নেবুরন নেছার ছেলে বাউল মঙ্গল সাধু। বর্তমান বয়স নব্বইয়ের কোটায়। তিনি প্রায় ৫০ বছর আগে এই বিশ্ব শান্তি আশ্রম গড়ে তোলেন। তার চাচাতো ভাই মৃত আবু তাহের মল্লিক ওরফে খোকা মল্লিক ও পটল নেছার ছেলে ইকবাল হোসেনের সহযোগিতায় এই আশ্রম সেজেছে নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে। এই আশ্রমে বছরে পাঁচবার ভক্তদের মিলন মেলা বসে। আশ্রমে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন ধরনের গাছ ও পশুপাখি। নিজ হাতে গড়ে তোলা আশ্রমেই থাকেন মৃত ওলি মল্লিকের ছেলে লালন তরিকার ভক্ত ৫ সন্তানের জনক মঙ্গল সাধু ও তার স্ত্রী জহুরা পাগলি। সেখানেই থাকেন তারই তরিকার বোন বৃদ্ধা সুন্দরী বেগম ও মিরাজুল ইসলাম। মিরাজুল ইসলাম ও স্থানীয় কয়েকজন ভক্ত নিয়মিত সকাল বিকাল আশ্রম ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করেন।
প্রায় ৫০ বছর আগে মঙ্গলসাধু গ্রামের প¦ার্শবর্তী মাঠে নিজের দেড় বিঘা ও চাচাতো ভাই ইকবাল হোসেনের দেয়া ১ বিঘা মোট আড়াই বিঘা জমির ওপর ছোট একটি কুঁড়ে ঘর তুলে কিছু ভক্ত নিয়ে তাদের তরিকা মোতাবেক কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে আশ্রমে ৫ বিঘা জমির ওপর ভক্তদের জন্য থাকা ও সাধু সঙ্গের মিলন মেলায় ভক্তদের বসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে টিনের ছাউনির শেড। মঙ্গল সাধুর ভসিষ্যৎ সমাধির জন্য কবরের মতো করে রাখা হয়েছে। ওই স্থানের নাম দেয়া হয়েছে কারবালা। মঙ্গল সাধু জানান, এই কারবালায় সত্যবাদী ও সৎ মানুষের দাফন হবে। দুষ্ট কোনো মানুষ এখানে আশ্রয় পাবে না। মঙ্গল সাধু বলেন আজকের এই বিশ্ব শান্তি আশ্রম একদিনে তৈরি হয়নি। এ জন্য আমাকে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে। এলাকার অনেকেই প্রথম পর্যায়ে আমার এই সাধুতা মেনে নেয়নি। আমি অনেক হয়রানি ভোগান্তির শিকার হয়েছি। আমাকে হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছে। তবু আমি দমে যাইনি। এলাকার কয়েকজন জানান, এলাকার কতিপয় লোকের ব্যাপক বিরোধিতা ও বাধা তাকে দমাতে পারেনি। বিভিন্ন সময় তাকে ভয় ভীতি দেখানো হয়েছে। পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে তবুও থামেননি তিনি। প্রথম দিকে তরিকার সাধুদের পরামর্শ মোতাবেক গাছের ওপরে কাটিয়েছেন ৮ বছর। ৮ বছর তিনি তার ভবিষ্যৎ সমাধিস্থলে মাটির নিচে কাটিয়েছেন। প্রতি বছর আশ্বিন সাসের ৮ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত এই স্থানে ভক্তদের মিলন মেলা ও সাধু সঙ্গের আয়োজন করা হয়। এখানে তাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়াও প্রতি বছরের পৌষ মাসের ১৫, পয়লা বৈশাখ ও ১০ বৈশাখ সাধু সঙ্গ চলে। এছাড়াও প্রতি মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার এলাকার সাধুদের নিয়ে সাধুসঙ্গ করা হয়।
বিশ্ব শান্তি আশ্রমে গাছে গাছে ঝুড়ি, মাটির ভাঁড় বেঁধে বাসা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন সকাল বিকেল পাখিদেরকে খাবার ছিটিয়ে দেয়া হয়। পাখিরা দলবেঁধে খাবার খেয়ে আবার গাছে গাছে আশ্রয় নেয়। মঙ্গল সাধুর চাচাতো ভাই ইকবাল হোসেন বলেন, বিশ্ব শান্তি আশ্রমে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছ। এর মধ্যে রয়েছে হাড় মচমচে, কাল নাগিনি, খোদাবাঘ, ছোট ভূতরাজ, বড় ভূতরাজ, ইশেলমূল, অনন্তমূল, শতমূল, হাজারি মূল, মাধরীসহ অসংখ্য চেনা-অচেনা গাছ। এছাড়া এই আশ্রমে এক প্রকার গাছ রয়েছে সেই গাছের পাতায় মানুষ স্পর্শ করলেই বিদ্যুতের মতো শক লাগে। এ কারণে এই গাছ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। যাতে কেউ ওই গাছে হাত না দেয়। এই আশ্রমে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় নাটাই, মোকড়া, বাসক, বাতাসে, শক্তিমূলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংগ্রহ করে এই আশ্রমে রোপণ করেছেন মঙ্গল সাধুর ভক্ত ও চাচাতো ভাই ইকবাল হোসেন।
মঙ্গল সাধুর স্ত্রী জুহরা পাগলি বলেন, ৫০ বছর আগে সাধুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেই থেকে বিপদে আপদে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি সাধুর সঙ্গে। আশ্রমে থাকা সুন্দরী বেগম বলেন, আমার ছেলে মেয়ে এবং বাড়ি সবই আছে। কিন্তু সেখানে আমার মন টেকে না। তাই বাড়ি থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে মঙ্গল সাধুর আশ্রমে ঠাঁই নিয়েছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানে থাকতে চাই। এখানকার কারবালায় চাই শেষ ঠিকানা। মঙ্গল সাধু বলেন, ‘আমি কারোর কাছে কিছু চাই না। রুজির মালিক একমাত্র আল্লাহ। তার ওপর ভরসা করে থাকি। এখানে যারা থাকেন সবারই খাওয়া থাকার ব্যবস্থা আশ্রম থেকেই হয়ে যায়। আমি বিশ্ব শান্তি আশ্রমের নামে আমার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছি। আমার অবর্তমানে আমার ভক্ত-শিষ্যরা যেন এই আশ্রমে থাকতে পারে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More