স্টাফ রিপোর্টার: দেশব্যাপী আলোচিত মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। মামলার বাকি তিন আসামি হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম এবং দুই ছেলে সজীব শেখ ও রাতুল শেখকে আদালত বেকসুর খালাস দিয়েছেন। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর ২১ দিনের মাথায় এবং মোট ১৪ কর্মদিবসে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলায় সরকারপক্ষের আইনজীবী মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি মনিরুল ইসলাম মুকুল। রায়ে প্রধান আসামির মৃত্যুদ- হলেও অভিযুক্ত অপরাপর তিন আসামি খালাস পাওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলাটির বাদী ৮ বছরের শিশুটির মা আয়েশা আক্তার। শনিবার সকালে মামলার রায়কে ঘিরে আদালত চত্বর ও আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আদালত চত্বরে উৎসুক জনতার ভিড় জমে। ভিড় করেন সাংবাদিকরাও। সকাল ৯টায় আসামিদের ঝিনাইদহ কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে মাগুরায় আদালতে আনা হয়। বিগত দিনগুলোয় বিচার চলাকালে আদালতে আনা-নেওয়ার পথে এই আসামিরা সাংবাদিকদের দেখে চিৎকার করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও এদিন ছিলেন একেবারেই চুপ। সাড়ে ৯টায় বিচারক এম জাহিদ হাসান সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। এ সময় আসামিদের একেবারেই নির্বাক থাকতে দেখা যায়। রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও তারা ছিলেন শান্ত। রায় ঘোষণার পর সরকারপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, মামলার ১নং আসামি হিটু শেখকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(২) ধারায় (ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর অপরাধ) অভিযুক্ত করে আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- এবং এক লাখ টাকা অর্থদ- দিয়েছেন। বাকি ৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। তবে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মেডিকেল অ্যাভিডেন্স ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা যায়, শিশুটির বোনের স্বামী ও ভাশুরের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৫০৬ ধারার দ্বিতীয় অংশ (ভয়ভীতি প্রদর্শন) এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দ-বিধির ২০১ ধারায় (অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ) অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। পরে ১৭ এপ্রিল মামলাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। ২৩ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৫ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সব্যসাচী রায়ের আদালতে শিশুটির বোনের শ্বশুর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। চার আসামির মধ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস দেওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিগ্যাল এইড নিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী সোহেল আহমেদ বলেন, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি চাইলে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বাদী শিশুটির মা বলেন, তিন আসামিকে খালাস দেয়ায় খুবই কষ্ট পেয়েছি। তারা ঘটনা ধামাচাপা না দিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে আমার মেয়েটি হয়তো বেঁচে থাকতো। আমি তাদের শাস্তি দেখতে চেয়েছিলাম। মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৬ মার্চ ধর্ষণের শিকার হয় মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ ঘটনার পর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ মার্চ দুপুরে শিশুটির মৃত্যু হয়। ৮ মার্চ শিশুটির মা বাদী হয়ে চারজনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন। শিশু ধর্ষণের খবর প্রচার হলে মাগুরাসহ সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। সড়ক অবরোধ, থানা ও আদালত ঘেরাও করে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে অপরাধীর শাস্তি দাবি করেন সর্বস্তরের মানুষ। স্থানীয় আইনজীবীরাও এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচার দাবির পাশাপাশি আসামিপক্ষকে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা না দেওয়ার ঘোষণা দেন। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন করার দাবি ওঠে। এ অবস্থায় দেশের উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়ে মামলাটি পরিচালনায় সরকারপক্ষের আইনজীবীকে সহায়তা দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার স্পেশাল প্রসিকিউটর অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী এবং আসামিপক্ষে জেলা লিগ্যাল থেকে অ্যাডভোকেট সোহেল আহমেদকে নিযুক্ত করা হয়। ধর্ষণ ও হত্যার বিচার যুগান্তকারী : শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দ্রুত রায় বিচার বিভাগের জন্য একটি যুগান্তকারী প্রদক্ষেপ বলে মনে করেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এমন একটি রায়-বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করবে। শনিবার আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণার পর ফেসবুক লাইভে তিনি এমন মন্তব্য করেন। শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সকাল আজ (শনিবার)। আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচারের রায় হয়েছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। এতে একজনের মৃত্যুদ-, বাকি তিনজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে হত্যা ও ধর্ষণের বিচার এই প্রথম জাতি সম্ভবত দেখেছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.