দেশে ফের বাড়ছে করোনার প্রকোপ : নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠা

একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়ালো : মৃত্যু হয়েছে আরও ৭ জনের

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ফের লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে ভিন্ন আশঙ্কা করছেন। তারা বলেন, গত কয়েকদিনে দেশে করোনায় শনাক্তের হার যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী তা কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক নয়। এটি সেকেন্ড ওয়েভের (দ্বিতীয় ঢেউ) আলামত হতে পারে, যা আগামী আরও তিন থেকে চার মাস দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, মৌসুমগত কারণে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও তা এর একমাত্র কারণ নয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এর পেছনে আরও ছয়টি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এর প্রতি আস্থা সর্বস্তরের মানুষের করোনাভীতি পুরোপুরি কেটে যাওয়া এবং এর ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে ‘থোরাই কেয়ার’ মনোভাব সংক্রমণ বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির করোনার উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়ার বিষয়টি করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশঙ্কাও করছেন তারা। আক্রান্ত করোনা রোগীর স্টেইন শনাক্তকরণে বিলম্ব ও টেস্টিং সংকটকে চতুর্থ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর বাইরে প্রবাস থেকে আগতদের নিয়ম অনুযায়ী কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা না করা, অতিরিক্ত লোক সমাগমের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ না থাকা এবং উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও করোনা টেস্ট না করিয়ে নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়ানোর ঘটনার আধিক্য এ মহামারি নতুন করে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। গত ২৪ ঘণ্টার নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ছিলো ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা গত ৫৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ হাজার ৩২টি নমুনা পরীক্ষায় ১ হাজার ১৮ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। দুই মাস আগে ১০ জানুয়ারি এক দিনে এর চেয়ে বেশি ১ হাজার ৭১ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। গত একদিনে মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। এদিকে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনে আক্রান্ত হওয়া ছয়জনের খোঁজ মিলেছে দেশে। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। গত জানুয়ারিতে ঢাকা ও সিলেটে যুক্তরাজ্য ফেরত করোনা আক্রান্ত ছয় ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির নতুন ধরন পাওয়া গেছে। গতকাল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয়জনের মধ্যে যুক্তরাজ্যের করোনার নতুন স্টেইন (পরিবর্তিত রূপ) পাওয়া গেছে। এই স্টেইনের সংক্রমণক্ষমতা বেশি। আমরা এটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি।’ তবে দেশে সংক্রমণ বাড়ার জন্য যুক্তরাজ্যের স্টেইনের প্রভাব নেই বলে জানান তিনি। এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘যুক্তরাজ্য ফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হচ্ছে। আক্রান্তদের আইসোলেশন করে তারা যাদের কাছাকাছি এসেছেন, শনাক্ত করা হচ্ছে তাদেরও। অনেকে হোটেলে থেকেছেন, আত্মীয়-পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। তবে কন্ট্রাক ট্রেসিং করে এখনো নতুন কারও মধ্যে এই স্টেইন ছড়ানোর প্রমাণ মেলেনি।’ আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, জানুয়ারির শুরুতেই যুক্তরাজ্য ফেরত যাত্রীদের মধ্য থেকে প্রথম এই ধরন শনাক্ত হয়। প্রথম যে যাত্রীর শরীরে নতুন এই ধরন শনাক্ত হয়, তিনি যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে তার শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যের নতুন ধরন শনাক্ত করে। এরপর সিলেটে ওসমানী বিমানবন্দরে নামা যাত্রীদের মধ্য থেকেও ভাইরাসের নতুন ধরনবাহী ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট ছয়জন শনাক্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পরই দেশটি থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের ব্যাপারে নানা সতর্কতা নেয়া হয়। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকেই যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে অনেক দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করলেও বাংলাদেশ তা করেনি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নতুন আরও একটি ধরন শনাক্ত হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ ১৭টি নতুন জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করে পাঁচটিতেই করোনাভাইরাসের নতুন স্টেইন পায়। যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন যে ধরন পাওয়া গেছে, সেটি আগের স্টেইনের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে ছড়ায় বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
এদিকে দেশে গত কয়েক মাসে সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হওয়ার পর নমুনা পরীক্ষায় ব্যাপক ঢিলেমি করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদ, আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গত কয়েক মাস ধরে মানুষের মধ্যে নমুনা পরীক্ষার আগ্রহ অনেকাংশে কমে এসেছে। কারণ করোনা শনাক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সামাজিকভাবে কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। এছাড়া বেশিরভাগ মানুষের কাজের নিশ্চয়তা নেই। দৈনিক মজুরিতে কাজ করা মানুষ নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হলে তাকে অর্থাভাবে পড়তে হবে। তাই উপসর্গ দেখা দেয়ার পরও অনেকে নমুনা পরীক্ষা করছেন না, যা নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন তিনি।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, নমুনা পরীক্ষার জন্য বর্তমানে সরকার নির্ধারিত যে ফি রয়েছে, তা এখন উঠিয়ে দেয়া উচিত। তার ধারণা, বিনা টাকায় নমুনা পরীক্ষার সুযোগ থাকলে এর গতি বৃদ্ধি পাবে, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।
দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীরা বলেন, দেশের অফিস-আদালত ও শপিংমলসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো অনেকটা বদ্ধ ধরনের। এসব জায়গায় বিপুল সংখ্যক মানুষ একই সময় জড়ো হচ্ছে। গত কয়েকদিনে গরমের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ মুখের মাস্ক খুলে রাখছে। অথচ এসব জায়গার বাতাস বের না হওয়ায় একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অনেকে সংক্রমিত হচ্ছে। এছাড়া কোথাও কোথাও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহৃত হওয়ায় সেখানে একই বাতাস সঞ্চালিত হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে।
এদিকে বিদেশ থেকে আগতদের করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’ সনদ না আনতে পারলে ১৪দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যাপারে গত নভেম্বরে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করলেও পরে দ্রুত ধাপে সংক্রমণ কমতে থাকায় এতে ঢিলেমি ভাব দেখা দেয়। বিমানবন্দরে এ ব্যাপারে কিছুটা নিয়ম মেনে চলা হলেও স্থল ও সমুদ্র বন্দরে তা অনেকাংশেই মেনে চলা হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই বেশ কয়েক মাস ধরে করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ফলে এ ব্যাপারে ঢিলেমি ভাব দেশের করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More