দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খুলছে আজ : মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিসহ নানা নির্দেশনা

শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও অভিভাবকদের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্ক : সংক্রমণ বাড়লে আবারও বন্ধ
স্টাফ রিপোর্টার: দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা আজ খুলছে। করোনার ছোবলে ৫৪৩দিন আগে সরকার দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছিলো। এরপর এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত একাধিকবার শ্রেণি কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সংক্রমণের দাপটে তা আর হয়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী কোথাও সংক্রমণের হার একটানা দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশে স্থিতিশীল থাকলেই সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে শনিবারও সংক্রমণের হার ৭ শতাংশের ওপরে ছিলো। অবশ্য এটা আগের দিনের তুলনায় প্রায় দেড় শতাংশ কম। সেই হিসাবে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের সরাসরি পাঠদানের জন্য ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ। শিক্ষক ও কর্মচারীরা শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত। স্কুলে যেতে প্রস্তুত শিক্ষার্থীরাও। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সোয়া ৩ কোটি শিক্ষার্থী। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে এখন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে না। এখনো বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও কোনো কোনো অভিভাবকের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্কও।
করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী; যারা নতুন ভর্তি হয়েছে, তাদের জন্য আজই হবে স্কুল-কলেজের প্রথম দিন। এজন্য অনেক স্কুলের ফটক সাজানো হয়েছে। কোনো কোনো স্কুল ড্রাম বাজিয়ে, করতালি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে দীর্ঘদিন পর ক্লাসে বসার আনন্দে মাতোয়ারা ছাত্রছাত্রীরা। এক সপ্তাহ ধরে তারা স্কুলব্যাগ, ড্রেস, জুতো ইত্যাদি কিনে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের স্বাগত জানাতে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও প্রস্তুত। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের স্কুল-কলেজ অনেকটাই নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। এছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তবু অভিভাবকরা কিছুটা অস্বস্তি আর উদ্বেগে আছেন।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন শনিবার বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে সরাসরি পাঠদান। এতে শিক্ষার অপরিমেয় ক্ষতি হচ্ছিল। তাই ক্ষতি আর না বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। পুনরায় ক্লাস শুরু উপলক্ষ্যে সরকার সার্বিক পদক্ষেপ নিয়েছে। মহামারি পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করা হয়েছে। শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ৯০ শতাংশকে টিকা দেয়া হয়েছে। এরপরও আমরা বসে থাকব। দৈনিক প্রত্যেকটি স্কুল মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ঢাকায় আসা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে। স্কুল খোলাকে সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের সমস্যা সমাধানের জন্য শনিবার মন্ত্রণালয় খোলা রাখা হয়েছিলো।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুল-মাদরাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ৯ স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য ৬৩ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুতের জন্য দেয়া হয়েছে আলাদা ১৯ দফা নির্দেশিকা। রুটিন তৈরির জন্য পাঠানো হয়েছে ১১ দফা করণীয়। আর স্কুল-কলেজের হোস্টেল খুলতে আলাদাভাবে দেয়া হয়েছে ১৪ নির্দেশনা। প্রাথমিক স্তরের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে মৌলিক রুটিন করে দেয়া হয়েছে। আর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে দেওয়া হয়েছে ১৬ দফা নির্দেশনা। উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই স্তরে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হলো কিনা সেই তথ্য দৈনিকই শিক্ষার মাঠ প্রশাসন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে পাঠাতে হবে ঢাকায়। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখতে সাধারণ মাঠ প্রশাসনকেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ১১ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা দৈনিক স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার সমস্যাসহ সার্বিক দিক বিকাল ৩টার মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) জানাবেন। একইভাবে উপজেলা ও থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও মনিটরিং করে প্রতিদিন বেলা ৪টার মধ্যে মাউশিতে প্রতিবেদন দেবেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করবেন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা। সমস্যা হলে তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিপিই) জানাতে হবে।
এদিকে শ্রেণিকাজ শুরুর পর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তুতিও আছে সরকারের। শনিবার জামালপুরে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী এ কথা উল্লেখ করে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান চললে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বিষয়টি নিশ্চিতে আমরা স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। আমরা কোনোভাবেই শিশুদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলা করবো না। তাই বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছি। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সেসব না মানে তাহলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যদি ফের সংক্রমণ বেড়ে যায় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ করা হবে। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই স্কুল খুলে দিতে হয়েছে। তবে যেহেতু সব এলাকায় সংক্রমণ সমান নয়। তাই কোনো এলাকায় পরিস্থিতি তেমন হলে সেখানের স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা আমরা ইতোমধ্যে পাঠিয়েছি। আমাদের কাছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর এখন পর্যন্ত ২৩ দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবশেষ করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে আগামী মধ্য অক্টোবরে।
পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য মৌলিক রুটিন তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এটি অনুযায়ী, প্রতিদিন পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হবে। সঙ্গে একেকদিন এক একটি শ্রেণির ক্লাস হবে। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে প্রয়োজনে দুই শিফটে ক্লাস নেওয়া যাবে। প্রথম শিফট সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৩টা ঘণ্টা চলবে। দুপুরে ৩০ মিনিটের বিরতি থাকবে। এরপর ক্লাস শুরু হয়ে বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিনই ক্লাস শুরুর আগে দশ মিনিট করে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা করতে হবে। এর আগে ৩০ মিনিট থাকবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশের জন্য। একসঙ্গে প্রবেশ ও বের হওয়া যাবে না। বুধ ও বৃহস্পতিবার কেবল পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাবে। অন্য চার দিন তাদের সঙ্গে আরেকটি শ্রেণির ক্লাস হবে। সে ক্ষেত্রে শনিবার চতুর্থ, রোববার তৃতীয়, সোমবার দ্বিতীয় এবং মঙ্গলবার প্রথম শ্রেণির ক্লাস হবে। এই চার শ্রেণির কেবল বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান হবে। আর পঞ্চম শ্রেণির সব বিষয়েই পাঠদান চলবে। মাধ্যমিক স্তরের জন্য প্রথমে রুটিন করা হলেও পরে বাতিল করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নিজের প্রয়োজনের নিরিখে কর্মপন্থা ঠিক করতে বলে দেয়া হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More