ফুলশয্যার রাতেই স্বামীর মৃত্যু, লাল শাড়ীতে খাটিয়ার পাশে বাকরুদ্ধ নববধূ

চুয়াডাঙ্গার তেঘরীতে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস পর দ্বিতীয় বিয়ে

লাবলু রহমান: মেহেদী মাখা হাত, লাল শাড়ি পরে স্বামীর লাশের খাটিয়ার পাশে নববধূ। বাকরুদ্ধ হয়ে নতুন স্বামীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চাপা কষ্টের ছাপ নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বসে আছেন তিনি। বাসর রাতেই প্রথম স্ত্রীর রেখে যাওয়া সোনার রুলি নিজ হাতে দ্বিতীয় স্ত্রীকে আর পরিয়ে দেয়া হলো না লিটন আলী মাস্টারের। বলা হচ্ছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়নের তেঘরী গ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী মৃত শুকুর আলীর ছেলে লিটন আলীর কথা। ছোট ভাই বিজিবিতে কর্মরত রয়েছেন। একমাত্র বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন নিজ বাড়িতে মাকে নিয়ে একাই বসবাস করতেন তিনি। লিটন আলী মাস্টার পাশ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার ধোপাবিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সাংসারিক জীবনে তার লামিয়া খাতুন নামের একটি ৯ বছর বয়সী কন্যাসন্তান রয়েছে। পুনরায় তার স্ত্রী গর্ভবতী ৭-৮ মাসের। বড় মেয়ে লামিয়ার টনসিল অপারেশন করে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তার স্ত্রী। অনাগত সন্তানের জন্য উন্নত চিকিৎসা বা এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার সম্ভব হয়নি বলে চিকিৎসক জানান। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হয়ে গত ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখ তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তার মেয়েকে জানতে দেয়া হয়নি মায়ের মৃত্যুর খবর। কারণ তার অপারেশন করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রায় আড়াইমাস পরে লিটন আলী মাস্টার গতপরশু শুক্রবার দিনগত রাতে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ঝিনাইদহ জেলার গান্না ইউনিয়নের কালুহাটি ঘোপপাড়া গ্রামের সোলায়মান হকের মেয়ে ফাতেমা খাতুনের সাথে। বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে রাত সাড়ে ১০টা বাজে। বাসর রাতেই প্রথম স্ত্রীর রেখে যাওয়া সোনার গয়না রুলি দ্বিতীয় স্ত্রীকে পরাতে গিয়ে হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। রুলি পরানো আর হলো না। হঠাৎ করে অসুস্থ হলে মাটিতে পড়ে তার দাঁত ভেঙে যায়। সাথে সাথে তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। হাসপাতালে যাবার প্রস্তুতি নেয়ার সময় হাসপাতালেই লিটন আলী মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়েন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবর। সাথে সাথে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কান্নাকাটি ও আহাজারির শব্দ। জানিজানি হবার পরে গ্রামের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শোকের মাতম বইতে শুরু করে। হতভাগ্য নববধূর নতুন সংসার গড়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। গতাকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো নববধূর হাতে মেহেদীর রঙ লাল শাড়ী পরে অপলক দৃষ্টিতে বাকরুদ্ধ স্বামীর নিথর দেহাবশেষের দিকে তাকিয়ে আছে। অঝরো ঝরছে চোখের অশ্রু। হৃদয় বিদারক শেষবারের মত মৃতের মুখখানি একবার দেখতে আসা ও গ্রামের লোকজন ভীড় করে। চাপা কষ্ট আর অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরছেন সবাই। চারপাশে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। তার এই হৃদয় বিদারক জীবনের প্রয়াণে। গ্রামের মানুষ একেবারে হতবিহ্বল। মেনে নিতে পারছেন না কেউ। তারপরও নিয়তির কাছে সবাই অসহায়। বাচ্চা আর নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন যেনো অপূর্ণ রয়ে গেলো। একের পর এক প্রকৃতির নিয়মের কাছে কতটা অসহায় পরিবারটি সেটা ভেবেই লোকজনের মধ্যে একটিই শব্দ উচ্চারণ হচ্ছে হায়! হায়! কি হয়ে গেলো। সকলের প্রিয় মিষ্টভাষী, সদালাপী মানুষটির এ প্রস্থান যেনো মনের মধ্যে দাগ কেটে গেলো। ফুলশয্যার রাতেই স্ত্রী বিধবা হলো। এর চাইতে একটি মেয়ের জীবনে আর কোনো কষ্ট থাকতে পারে না। একমাত্র মেয়ে লামিয়া খাতুন (৯) প্রথমে মাকে এবং পরে পিতাকে হারিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছে। পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ রইলো না লামিয়ার। এলাকাবাসী ও নিকটাত্মীয় স্বজনদের কান্নার আহাজারিতে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। লিটন আলী মাস্টার স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন চাঁনের ভাতিজা। তিনি জানান, পরিবারটির ওপর দিয়ে একের পর এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মা মরা মেয়েটি তার পিতাকে হারিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে পড়লো। নিয়তির ওপরে তো কারো হাত নেই। তবে এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। বাসর রাতেই স্ত্রী বিধবা! খুবই কষ্টদায়ক ঘটনা। গতকাল শনিবার বাদ মাগরিব জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফনকাজ করা হয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More