ফের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে করোনা : নমুনা পরীক্ষার অর্ধেকই পজিটিভ
আতঙ্কিত না হয়ে জনসাধারণকে সতর্ক ও সচেতন থাকার পরামশ
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে আবারও দেখা দিয়েছে করোনার প্রভাব, শনাক্ত হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। ফলে জনমনে বাড়াচ্ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সেই মহামারী ভাইরাস আবারও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে কিনা বা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কতটুকু সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনা বিষয়ক নিয়মিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৮ জনের কাছ থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে যার মধ্যে ১৪ জনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষার অর্ধেকই করোনায় আক্রান্ত। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭২০ জনে। যদিও একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসায় সম্প্রতি বেশ কিছুদিন ধরে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এর মধ্যে গেলো দুই দিনে রাজশাহীতেই ১১ জন করোনা পজিটিভ হওয়া খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন। এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. খন্দকার মো. ফয়সাল আলম বলেন, আক্রান্তদের উপসর্গ প্রায় একই ধরনের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও একই উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। এদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে করোনাভাইরাস। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে ক্রমেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, তবে সেটা সীমিত পরিসরে।
দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের ২৬ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চারদিনে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২৬ মে পর্যন্ত ভারতে মোট কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১০ জন। সেখানে ৩০ মে পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১০ জনে। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে সংক্রমণ প্রায় তিনগুণ।
দেশটির অন্যতম রাজ্য কেরালায় এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১,১৪৭ জন। মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৪ এবং দিল্লিতে ২৯৪ জন। গুজরাটে এই সংখ্যা ২২৩ জনে দাঁড়িয়েছে। তামিলনাড়ুতে ১৪৮, কর্ণাটকেও ১৪৮ এবং পশ্চিমবঙ্গে ১১৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া, রাজস্থানে ৫১, উত্তরপ্রদেশে ৪২, পুদুচেরিতে ২৫ এবং হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, ওড়িশা, পাঞ্জাব ও জম্মু-কাশ্মীরেও করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
মৃত্যুর হিসাব অনুযায়ী, দেশে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। মহারাষ্ট্র ও দিল্লিতে মারা যাওয়া দুজন কোভিড-১৯ ছাড়াও অন্যান্য গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছিলেন। বাকিদের মৃত্যুর কারণ নির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই বয়স্ক নাগরিক।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) ডিরেক্টর জেনারেল ড. রাজীব বেহল জানিয়েছেন, বর্তমানে সংক্রমণের হার বাড়লেও এটি গুরুতর নয় এবং সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভারতে সংক্রমিত করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি ভারত থেকে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী আশপাশের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। কেননা, ভারতে শনাক্ত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে বাংলাদেশেও শনাক্ত হচ্ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংক্রমণের মাত্রা সামান্য। উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, হালকা জ্বর, হাঁচি, কাশি, দুর্বলতা, গলায় ও ফুসফুস সংক্রমণ। অধিকাংশ রোগীরা বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। তবে কারও কারও সংক্রমণ বেশি হচ্ছে, তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আবার করোনা পরবর্তী জটিলতায় মারা যাওয়া খবরও পাওয়া যাচ্ছে। গত ১ জুন রাতে করোনা পরবর্তী পরবর্তী জটিলতায় মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী অর্ভিন আদিত্য। কয়েকদিন ধরে করোনা পরবর্তী ফুসফুস জটিলতায় ভুগছিলেন। ভর্তি ছিলেন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টার পরও মেডিকেল জগতের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল নক্ষত্র এই মেধাবী শিক্ষার্থী বাঁচানো যায়নি।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে সংক্রমণের হার বাড়লেও এটি গুরুতর নয় এবং সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই সঙ্গে বর্তমানে বিশেষ কোনো বিধিনিষেধের প্রয়োজন নেই, তবে জনসাধারণকে সতর্ক ও সচেতন থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক মো. ফরহাদ হোসাইন বলেন, করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন হয়েছে। যার কারণে কয়েক দিন ধরেই করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস একেবারে কখনই পৃথিবী থেকে নির্মূল হবে না। কোনো না কোনোভাবে থেকে যাবে। সেভাবে মানুষ আক্রান্ত হবে না। সময়ে সাথে সাথে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসবে এবং ক্রমেই করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে সতর্কতার বিকল্প নেই, সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এই সময়ে ডেঙ্গুরও প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আবহাওয়াজনিত কারণেও মানুষের সর্দি, কাশিসহ নানা রোগ ব্যাধি হচ্ছে। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন হয়েছে। যার ফলে মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। করোনাভাইরাস নিয়ে আগের মতো উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই। তবে মেনে চলতে হবে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি। নিজের সুরক্ষার চিন্তা নিজেকেই করতে হবে। আগের মতো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ভাইরাস থেকে অনেকটা দূরে থাকা সম্ভব।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা এবং ডেঙ্গু; সমানে যারা দুটিতেই আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের শারীরিক অবস্থা বেশি অবনতি হচ্ছে। আর এই সময়টা ডেঙ্গুর, আর চাইলেও পৃথিবী থেকে করোনা নির্মূল করা সম্ভব নয়। করোনা ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে যাবে। প্রতিরোধের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলেই করোনা পরীক্ষা করতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, ডায়াবেটিসসহ জটিল সমস্যায় ভোগা মানুষদের ব্যাপারে এটা জটিলতা তৈরি করতে পারে। এ জন্য সবাইকে সতর্ক হওয়া দরকার।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে চীন থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছিল। এরপর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তির কথা প্রথম জানা যায় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। দেশে প্রথম মৃত্যু ঘটে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। এরপরের দুই মাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ৩ অঙ্কের মধ্যে ছিল, যা বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে সর্বোচ্চে পৌঁছেছিল। ২ জুলাই সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের ৫ ও ১০ আগস্ট দু-দিন করোনায় সর্বাধিক ২৬৪ জন করে মারা যান। পরে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে বাংলাদেশেও।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.