ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যুপুরী তুরস্ক-সিরিয়া : ধ্বংসস্তূপে লাশের পর লাশ

কাঁদার লোকও নেই অনেক পরিবারে : আটকা পড়ে আছেন অসংখ্য মানুষ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: তুরস্ক ও সিরিয়া মৃত্যুপুরী। বেরিয়ে আসছে লাশের পর লাশ। অনেক পরিবারের সবাই নিহত হয়েছেন। ফলে এসব নিহতের জন্য কাঁদার মানুষ পর্যন্ত নেই। ভয়াবহ ভূমিকম্পে দুই দেশে কেড়ে নিয়েছে কমপক্ষে দুই হাজার ৬১৯ জন মানুষকে। এর মধ্যে তুরস্কে কমপক্ষে এক হাজাপর ৬৫১ জন মারা গেছেন। সিরিয়ায় এ সংখ্যা ৯৬৮। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন অসংখ্য মানুষ। তাদের কী অবস্থা তা অনিশ্চিত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিল মৃতদেহ। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামে তা অজানা। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ আফাদ বলেছে, কমপক্ষে দুই হাজার ৮৩৪টি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূমিকম্পের পরে ১২০টি আফটারশক রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ভোরবেলা। তখন ঘড়িতে সময় প্রায় ৪টা। বেশির ভাগ মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঠিক সে সময় মুহূর্তের মধ্যে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও সিরিয়ার বেশির ভাগ এলাকা। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ৭ দশমিক ৮। বহুতল ভবন ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। মোমের মতো ধসে পড়েছে একাধিক ভবন। সঙ্গে সঙ্গে লাশ। লাশ আর লাশ। চারদিকে শুধু লাশ। এত লাশের ভার নিয়ে দেশ দু’টির আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যারা বেঁচে আছেন, হতাশায় তাদের চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝে উঠতে পারছেন না যে, এখনো বেঁচে আছেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ২৪ মিনিটের দিকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে তুরস্কে। এএফএপি ইমার্জেন্সি কর্তৃপক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজি সার্ভিস এই ভূমিকম্পের বিষয়ে রিপোর্ট করেছে।

অগভীর এই ভূমিকম্প দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্বের শহর একিনোজুতে আঘাত হানে। এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।  দক্ষিণ তুরস্কের গাজিয়ানতেপ প্রদেশের পূর্বদিকে নূরদাগি শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ভূগর্ভের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে প্রথম ভূ-কম্পনের উৎস। এর ১১ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার কেঁপে ওঠে সিরিয়া, সাইপ্রাস ও লেবাননের কিছু অংশ। ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে ইরাকেও। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুরস্কের গাজিয়ানতেপে। ওদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৯। ভূম্পিকম্পটি রাজধানী আঙ্কারা এবং তুরস্কের অন্যান্য শহরেও অনুভূত হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট পুরো অঞ্চলজুড়েই কম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূমিকমেপর কারণে সীমান্তের দুই পাশেই শত শত ভবন ভেঙে পড়েছে। নিহতের সংখ্যা দ্রুত আরও বাড়তে পারে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে মিশর, নেবানন, সাইপ্রাস থেকেও। ওদিকে সুনামি সতর্কতা জারি করেছে ইতালি। ভূমিকমেপর পর তুরস্ক আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে। এরপর ত্রাণ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ইমানুয়েল ম্যাক্রনসহ বিশ্ব নেতারা। সহমর্মিতা জানিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে বার্তা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানকেও তিনি একই ধরনের ভিন্ন আরেকটি বার্তা পাঠিয়েছেন।

পাশাপাশি পুতিন আশ্বাস দেন, এই বিপর্যয়কর মুহূর্তে যেকোনো ধরনের সহযোগিতার জন্য রাশিয়া প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া সঙ্গে সঙ্গেই দুটি আইএল-৭৬ বিমানকে সিরিয়ায় পাঠিয়েছে মস্কো। এগুলো উদ্ধারকার্যে সিরিয়ার বাহিনীকে সাহায্য করবে। সিরিয়ায় শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত রুশ সেনারা এরইমধ্যে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমিকমেপ সিরিয়ায় থাকা তাদের সামরিক ঘাঁটির কোনো ক্ষতি হয়নি। সিরিয়ায় ১৯৯৫ সালে জাতীয় ভূমিকম্প কেন্দ্র তৈরি হওয়ার পর এটিই সে দেশে আঘাত করা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প বলে জানিয়েছেন ঐ কেন্দ্রের প্রধান রায়েদ আহমেদ। ভূমিকমপ আঘাত হানা অঞ্চলে জরুরি উদ্ধারকার্য পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সোমবার সকালেই তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। সিরিয়ার সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে আলেপ্পো, হামা এবং লাটাকিয়া প্রদেশ। উদ্ধার অভিযান ও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সিভিল ডিফেন্স, দমকল, স্বাস্থ্য, পাবলিক কনস্ট্রাকশন কোমপানি এবং তাদের শাখাগুলোকে নিয়োজিত করেছে সিরিয়া সরকার। দেশের সকল প্রদেশ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যথাসম্ভব পরিবহন সরবরাহ করতে। সারা দেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা গৃহহীন হয়েছেন তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে আশ্রয় এবং খাদ্য নিশ্চিত করা হচ্ছে। তুরস্কে সব থেকে বেশি প্রাণহানি হয়েছে মালাতিয়া প্রদেশে।

এ ছাড়া দিয়ারবাকির এবং ওসমানিয়ে প্রদেশেও বহু হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় ভবন ধসে পড়েছে। লেবানন ও সাইপ্রাসেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন তুরস্ক ও সিরিয়ার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া সহায়তা করতে ইতিমধ্যে ইইউ’র দল রওনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। বিবৃতিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কমিশনার জোসেপ বোরেল এবং জ্যানেজ লেনারসিস বলেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে মাঠপর্যায়ে সহায়তার জন্য রোমানিয়া, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, গ্রিস, ফ্রান্স, চেচনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং বুলগেরিয়ার ১০টি আরবান সার্স অ্যান্ড রেসক্যু টিম পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার টিম পাঠাতে চেয়েছে ইতালি, হাঙ্গেরি, ইসরাইল, কাতার ও ইউক্রেন। ভেঙে পড়া বাড়িগুলোর নিচে এখনো বহু মানুষ আটকা পড়ে আছে। তুরস্কে একটি শপিংমল ধসে পড়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই দীর্ঘ সময় ধরে কম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটি আঘাত হানার কয়েক মিনিট পরেই দ্বিতীয় আরেকটি কম্পন অনুভূত হয়। উল্লেখ্য, তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোর একটিতে অবস্থিত। এর আগে ১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More