মধ্য এপ্রিলে আরও বাড়ার শঙ্কা : স্বাস্থ্যাবিধি মানতে হবে মানাতে হবে

দেশে করোনায় আরও ৬৩ জনের মৃত্যু : শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬২৬ জন
স্টাফ রিপোর্টার: এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে করোনা সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই মুহূর্তে সংক্রমণশীলতা (রিপ্রোডাকশন নম্বর) দেড় শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি একের অধিক ব্যক্তিকে সংক্রমিত করছেন। এছাড়া জনসাধারণের প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার প্রতি অনীহা, অতি সংক্রমণশীল এলাকায় পরীক্ষা করে রোগীদের আইসোলেশনে নেয়া এবং স্বজনদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গরোধ) না-করার কারণেই মূলত দিনদিন সংক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, দৈনিক আক্রান্ত রোগীর হার ২ থেকে বর্তমানে প্রায় ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বেশিরভাগ জেলায় কোভিড রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ না-করায় সেখান থেকে রোগীরা ঢাকামুখী হচ্ছেন। কিন্তু ঢাকায় এই বিপুলসংখ্যক রোগীর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে সরকার শর্তসাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু সব অফিস খোলা রেখে, যানবাহন চালু রেখে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেটি কাজে আসছে না। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি দুদিন আগে জানিয়ে দেয়ায় পর্যাপ্তসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে যারা ভাইরাসটির বাহক ছিলেন, তারা এটি নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে সংক্রমণের হারও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভাইরাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় সংক্রমণের হার আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। গত বছর আমাদের দেশে ইটালিয়া ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। এ ধরনের সংক্রমণের পর মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমানে যে ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ ছড়াচ্ছে সেক্ষেত্রে ওই অ্যান্টিবডি কোনো কাজে আসছে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এসব নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। এখনো দেশের বেশিরভাগ জেলায় আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) স্থাপন করা হয়নি। কারণ, ওই জেলা হাসপাতালগুলোয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই। প্রধানমন্ত্রী বলার পরও এই কাজগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ওইসব জেলার সব রোগী উন্নত চিকিৎসা পেতে ঢাকায় আসছেন। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুদিন আগেই সবাইকে জানিয়ে দিলো। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ গণপরিবহণে গাদাগাদি করে গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। ফলে পরিবহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় রোগটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এদিকে সব অফিস-আদালত, কলকারখানা খোলা রেখে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। এমনকি বাস চলাচলের অনুমতি দেয়া হলো। কিন্তু অতি সংক্রমণশীল এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পরীক্ষা বাড়ানো, আক্রান্তদের আইসোলেশন এবং আক্রান্ত পরিবারগুলোকে কোয়ারেন্টিন করা হলো না। অর্থাৎ, সামগ্রিক পরিবেশটি সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়ক।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬২৬ জন, যা একদিনে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এর আগে মঙ্গলবার শনাক্ত হয় সাত হাজার ২১৩ জন। গত এক বছরের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২৯ মার্চ করোনা শনাক্ত হন পাঁচ হাজার ১৮১ জন। সেই রেকর্ড ভেঙে আবার ৩১ মার্চ শনাক্ত হন পাঁচ হাজার ৩৮৫ জন। ১ এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজার ৪৬৯ জন। ২ এপ্রিল আবারও আগের রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮৩০ জনে। এরপর ৪ এপ্রিল একদিনে শনাক্ত দাঁড়ায় সাত হাজার ৮৭ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৩ জনের। মঙ্গলবার ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর আগে গত বছরের ৩০ জুন সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিলো ৬৪ জন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমরা কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করেছি। আগে দিনে দেড়শ পরীক্ষা হতো, এখন ৩৫ হাজার পরীক্ষা হচ্ছে। কোভিড রোগীদের সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কোভিডের কারণে নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগামীতে এই দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রধানমন্ত্রীর ১৮ নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তাহলে কোভিডকে তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। কিন্তু বেপরোয়া হয়ে যাওয়া কোভিডের সংক্রমণের হার দুই শতাংশ থেকে ২৪ শতংশে উন্নীত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আজ যেটা করব কাল সেটার ফল পাবো।
সংক্রমণের হার বাড়া প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন বলেন, বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণশীলতা (রিপ্রডাকশন নম্বর) প্রায় দেড় শতাংশ। অর্থাৎ, একজন থেকে একের অধিক ব্যক্তি সংক্রমিত হচ্ছে। এ হার একের নিচে নামাতে না-পারলে আক্রান্ত কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি সংক্রমণ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব না-মানা, মাস্ক ব্যবহার না-করা এমনকি জনসমাগম বন্ধ না-করার ফলে সংক্রমণের হার বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোয় সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন বলেন, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না-করে বিধিনিষেধ আরোপ করায় সেটি কেউ মানছে না। এখনো হাসপাতালগুলোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। এই অবস্থায় সংক্রমণশীলতা (রিপ্রডাকশন নাম্বার) দুই শতাংশে উন্নীত হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More