মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ ক্লাসে নেই শিক্ষার্থীরা মাঠে নেই কোলাহল : বাজেনি ক্লাস শুরুর ঘণ্টা

স্টাফ রিপোর্টার: মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন নয়। তবুও উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ বন্ধ। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের শোরগোল নেই, বাজেনি কোনো ক্লাস শুরুর ঘণ্টাও। মাঠে নেই হইচই। ব্যস্ততা নেই শিক্ষক-অভিভাবকদেরও। অথচ গত সোমবার সকালেও ছিলো এসব আয়োজন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোলাহলে মুখর ছিলো পুরো স্কুল প্রাঙ্গণ। তবে দুপুরে নেমে আসে বিষাদ। গত পরশু সোমবার দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে একটি যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির হায়দার আলী ভবনে। যেখানে প্রাথমিকের কয়েকটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ছিলো। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় এরই মধ্যে মারা গেছেন ৩১ জন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মাইলস্টোন স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল ও কলেজের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা আছেন সেখান। কারও কারও শরীরে স্কুল ড্রেস, কারও গলায় আইডি কার্ড। স্কুলমাঠে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের চোখে মুখে চাপা আতঙ্ক আর বিষাদের ছায়া।
হায়দার আলী ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন অভিভাবককে নীরবে চোখের পানি ফেলতে দেখা যায়। কেউ কেউ এ দুর্ঘটনায় হতাহতে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তবে বেশিরভাগকেই চুপ করে আগুনে পোড়া ভবনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। শিক্ষকদের মঙ্গলবার ছিলো না ক্লাসে যাওয়ার তাড়া। মাঠে এলোমেলো দাঁড়িয়ে ও বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের মুখেও অজানা শঙ্কার ছাপ। বাঁশি বাজিয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা ব্যস্ত ছিলেন উৎসুক জনতার ভিড় নিয়ন্ত্রণে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্কুলের পেছনের গেটে কথা হয় এক অভিভাবকের সঙ্গে। সাগর নামের এ অভিভাবক নিখোঁজ শিক্ষার্থী রাইসা মনির মামা। সাগর বলেন, রাইসা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওকে গতকাল (সোমবার) থেকে খুজঁছি। আমি ও রাইসার বাবা-মা আটটা হাসপাতালে খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। আমরা সারারাত অনেক জায়গায় গিয়েছি। রাইসার বাবা-মা ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমি খুজঁতে স্কুলে এলাম।
ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেল ও স্কুল কর্তৃপক্ষ কেউ বাচ্চাটার খোঁজ দিতে পারছে না, আক্ষেপের সুরে জানালেন এই অভিভাবক। তবে বিকেলে সিএমএইচ হাসপাতালে রাইসা মনির মরদেহের সন্ধান পায় পরিবার। প্রতিষ্ঠানটিতে ইংরেজি ভার্সন, বাংলা ভার্সন ও কলেজের জন্য আলাদা ভবন এবং আলাদা প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষকরা কেউ স্কুল শাখার, কেউ কলেজ শাখার। প্রাথমিক শাখার কোনো শিক্ষককে খুঁজে পাওয়া গেলো না। আফরিন নামের এক শিক্ষক বলেন, জুনিয়র টিচারদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। একজন মারা গেছেন শুনেছি। আরেক শিক্ষক বলেন, আমাদের ভবন আলাদা, সবাই সবাইকে চিনি না। কতোজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ছিলো তা বলতে পারবো না। স্কুল প্রশাসন বলতে পারবে। তবে বাংলা ভার্সনের স্কুল ও কলেজের প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মাইলস্টোন কলেজের পরিচালক রাসেল তালুকদার বলেন, শিক্ষকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এত বড় দুর্ঘটনা, এত প্রাণহানি- শিক্ষকরা মেনে নিতে পারছেন না। নিহত-আহতদের তথ্যের বিষয়ে হেল্প ডেস্ক চালুর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস, মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল সবার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা বিস্তারিত জানাবো। এক নম্বর ভবনের নিচে এ সংক্রান্ত হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। শিক্ষকরা সেখানে তথ্য হালনাগাদ করছেন। অভিভাবকরা সেখানে তথ্য দিচ্ছেন, নিচ্ছেন। রাসেল তালুকদার আরও বলেন, অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা শোকাহত, মর্মাহত। কলেজ শাখার শিক্ষক ওসমান মনি বলেন, স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে বলতে পারছি না।
কথা হয় একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শান্ত, কাব্য ও সুমিশা আক্তারের সঙ্গে। সবার অভিযোগ, মৃতের সংখ্যা সরকার ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। পাশাপাশি স্কুলের ওপর দিয়ে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের দাবি জানান তারা।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিন বলে, দুর্ঘটনায় আমার বন্ধু মারা গেছে। ছুটির পর যখন বিমানটা স্কুলে পড়ে তখন আমি মাঠে। প্রচ- শব্দে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
জাহিন জানায়, ওই ভবনে বাংলা বিভাগের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছিল। পাশে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম, টিচার্স রুম ছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, পুড়ে গেছে হায়দার আলী ভবন। পুরো ভবনটি ঘিরে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী। দোতলা বিশিষ্ট ভবনে ছয়টি কক্ষ দেখা যায়। নিচতলার এক রুমের সামনে ও পেছনের দেওয়াল ভাঙা। এই রুমেই আছড়ে পড়ে যুদ্ধবিমান।
শিহাবুল নামের এক অভিভাবক বলেন, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু এই শিশুগুলো আর ফিরবে না। কার দোষ আছে, কার ত্রুটি আছে- তদন্ত করে বের করা হোক।
এদিকে, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাস পরিদর্শনে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এসময় তারা শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। এর আগে সকালে শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি ঘোষণা করে আন্দোলনে নামেন। সরকারের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি মানা হলেও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের গোলচত্বরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। তারা বিমান দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ তুলে দিনভর বিভিন্ন সেøাগান দেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেখান থেকে পুলিশের পাহারায় বের হওয়ার চেষ্টা করে আবারও ব্যর্থ হন দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব। এসময় তাদের গাড়িবহর শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে ফের মাইলস্টোন কলেজে ফিরে যায়। তারা আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং কলেজের ৭ নম্বর একাডেমিক ভবনে গিয়ে অবস্থান নেন। উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় দিনভর ওই ভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়। অবশেষে রাত সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ পাহারায় তাদের গাড়িতে করে ক্যাম্পাস থেকে বের করা হয়।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More