মাইলের পর মাইল ধ্বংসস্তূপ : মৃত ছাড়ালো ৬ হাজার : আটকা হাজার হাজার মানুষ

বৈরী আবহাওয়ায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত : ২২ ঘণ্টা পর জীবিত নারী উদ্ধার ধ্বংসস্তূপের নিচে শিশুর জন্ম

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মাইলের পর মাইল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুই দেশের বেশ কয়েকটি শহরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়ে আছে। দুর্ঘটনার পর দুদিন পেরিয়ে গেলেও তুষারপাত ও তীব্র ঠান্ডায় উদ্ধারকাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যেখানেই প্রাণের সন্ধান পাচ্ছেন সেখানেই তারা ছুটে যাচ্ছেন। ২২ ঘণ্টা পর তুরস্কে এক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক শিশুর জন্ম হয়েছে।

সোমবার ভোরে সংঘটিত ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মঙ্গলবারও তুরস্কে ভূমিকম্প হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা-দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। হতাহতের ঘটনায় দেশে সাত দিনের শোক এবং তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে তুরস্ক সরকার। এদিকে এ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যস্ত দেশ দুটির পাশে গোটা বিশ্ব দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞ দল ও নানা সরঞ্জাম দিয়ে উদ্ধার প্রচেষ্টায় নানা দেশ সহায়তার চেষ্টা করছে। অনেক দেশ ইতোমধ্যে জরুরি ত্রাণসাগ্রহী পাঠিয়েছে।

সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রথম ভূমিকম্প আঘাত হানার পর দ্বিতীয় শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। মঙ্গলবার তুরস্কের মধ্যাঞ্চলে ভূমিকম্প আবার আঘাত হানে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলেছে, সোমবার তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ১০০টি আফটার শক হয়েছে। ভূমিকম্পে তুরস্কের অন্তত ১০টি শহর তছনছ হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখা গেছে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজারের মতো ভবন ধসে পড়েছে। ভূমিকম্পে তুরস্কের ঐতিহাসিক গাজিয়ানতেপ দুর্গ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুরস্কের হুরিয়েত ডেইলি নিউজ জানায়, একই ভূমিকম্পে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ায় বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সানলিউরফা প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হানার ২২ ঘণ্টা পর ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হতাইয়ের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকাপড়া এক নারীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল, সাহায্য চেয়ে ডাকছিলেন তিনি। কাছেই প্রাণহীন এক শিশুর দেহ পড়ে ছিল। এ নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে দেনিজ বলে পরিচয় দেয়া স্থানীয় বাসিন্দা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, তারা আওয়াজ করছেন, কিন্তু কেউ আসছে না। আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি, আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। ও আল¬াহ, তারা ডাকছে। তারা তাদের বাঁচাতে বলছে, কিন্তু আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না। কীভাবে আমরা তাদের বাঁচাব? সকাল থেকে এ পর্যন্ত এখানে কেউ আসেনি। ভূমিকম্পের ২৪ ঘণ্টা পরও ওই অঞ্চলে কোনো উদ্ধারকর্মী পৌঁছাতে পারেনি। ওয়েবসাইটটির তুরস্কের ব্যুরো প্রধান টুইটে বলেন, ‘পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে সাহায্য চেয়ে অনেকেই মেসেজ দিচ্ছেন।’ ডক্টর্স উইথাউট বর্ডার্স বলেন, তাদের একজন সদস্য সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন।

তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে প্রায় ২৫ হাজার জরুরি সেবার কর্মী কাজ করছেন। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭৪০ জন উদ্ধারকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে এবং ৪১ হাজারেরও বেশি তাঁবু, এক লাখ বিছানা ও তিন লাখ কম্বল দুর্গত এলাকাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে তুর্কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, তুরস্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৪১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আহতের সংখ্যাও বেড়ে ২০ হাজার ৫৩৪ জন হয়েছে।

সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুর্কি শহর আন্তাকিয়ায় ১০ তলা ভবন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জরুরি কর্মীদের উদ্ধার কাজ চালাতে দেখা যায়। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া লোকজনকে রক্ষা করতে উদ্ধারকারীরা হিমশিম খান। শহরটিতে বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানিও নেই। এর মধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করায় তাপমাত্রা নেমে হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে যায়। ভূমিকম্পকবলিত অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ এলাকায় বহু অ্যাপার্টমেন্ট ব¬ক ধসে পড়ে, হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ আহত ও গৃহহীন হয়ে পড়ে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া লোকজনকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাওয়ায় রাতে উদ্ধারকাজ অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উদ্ধারকারী পরিষেবাগুলো দেশটিতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে সিরিয়া আগে থেকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, এখন ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের ধাক্কায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে।

স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের ধ্বংস্তূপের নিচে এক শিশুর জন্ম হয়েছে। তবে জন্মের পরপরই শিশুটির মা মারা গেছে। তালহা সিএইচ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ওই নবজাতককে উদ্ধারের ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, এক উদ্ধারকারী একটি শিশুকে হাতে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন। ওই সময় শিশুটির শরীরে কোনো পোশাক ছিল না। তাকে ঢাকার জন্য অপর এক উদ্ধারকারী একটি চাদর ছুড়ে দেন। ভিডিওটির শিরোনামে লেখা হয়, একটি শিশু জন্ম নেয়ার মুহূর্ত। সিরিয়ার আলেপ্পোতে তার মা ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিলো। শিশুটির জন্মের পরই তার মা মারা গেছেন। তবে শিশুটি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সেটি উল্লেখ করা হয়নি।

তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াতে পারে: সিরিয়া সীমান্তে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কারণ উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে খুঁজে পাচ্ছেন। ডব্লিউএইচওর সিনিয়র ইমার্জেন্সি অফিসার ক্যাথরিন স্মলউড বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় একই জিনিস দেখতে পাই। দুর্ভাগ্যবশত শুরুর দিকে হতাহতের সংখ্যা যা থাকে, পরবর্তী সপ্তাহে তা বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তিনি বলেন, তুষারপাত ও তীব্র ঠান্ডার মধ্যে অনেক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। নিহত মানুষের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত উত্তর সিরিয়ার বাসিন্দা। এসব এলাকায় লাখ লাখ শরণার্থী তুরস্কের সীমান্তের দুই পাশে শিবিরে বসবাস করেন। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কয়েকশ প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।

তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে বিভিন্ন দেশ : শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিরিয়া ও তুরস্কের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ড। এরই মধ্যে তুরস্কের উদ্দেশে রওনা করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। এছাড়া চিকিৎসক দল, ধসেপড়া ভবনের নিচে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধারে প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াডও পাঠিয়েছে দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, সৌদি আরব, কাতারও সব ধরনের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

তুরস্কের প্রতিবেশী দেশ গ্রিসও বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর একটি বিমানে করে উদ্ধারকারী দল তুরস্কে পৌঁছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত তাৎক্ষণিক সাড়ে ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। কাতারও তুরস্কে সহায়তা ও উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে।

তুরস্ককে ৬ মিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তা দিচ্ছে চীন : চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়-ত্রাণ প্রচেষ্টার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে চীন ৪০ মিলিয়ন ইউয়ান বা ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিচ্ছে তুরস্ককে। এছাড়া চীনের রেড ক্রস তুরস্ক ও সিরিয়াকে দুই লাখ ডলার করে জরুরি সহায়তা দেবে। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই ত্রাণসামগ্রীসহ উদ্ধারকর্মী দল পাঠিয়েছে তুরস্কে।

আসাদ সরকারকে ছাড়াই সিরিয়ার পাশে দাঁড়াতে চায় ওয়াশিংটন : ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়া উভয় দেশের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখনো সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি দেশটি। সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সিরিয়ায় সহায়তা পাঠাবে। এ সহায়তা কার্যক্রমে তারা সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যাবে না। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয় না যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More