মিয়ানমারে ধরপাকড়ের হিড়িক : সু চি-বিরোধীদের নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ : নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান : নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ
মাথাভাঙ্গা মনিটর: মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর ধরপাকড় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের আটক করা হচ্ছে। শহরে শহরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে। মন্ত্রিসভায় রদবদলও শুরু হয়েছে। ২৪ জন মন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং ১১ জনকে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। শপথ নেয়া মন্ত্রীদের অধিকাংশই সেনা কর্মকর্তা। স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি-বিরোধী দলগুলোর নেতাদেরও মন্ত্রী করা হচ্ছে। এদিকে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। অভ্যুত্থানের ঘটনায় লন্ডনে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ব্রিটিশ সরকার। অভ্যুত্থানের পর দেশটির বিভিন্ন শহরে সামরিক বাহিনীর টহল ও তৎপরতা বেড়েছে। মঙ্গলবার সেনা ও দাঙ্গা পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় টহল দিতে দেখা যায়। রাজধানী নেপিদোয় হেলিকপ্টার চক্কর দিতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা ও পুলিশের গাড়ি অবস্থান করে। ইয়াঙ্গুগুনের পরিস্থিতিও একই রকম। চালু হয়নি ইয়াঙ্গুগুন বিমানবন্দর। দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড় শুরু হওয়ায় শহরগুলোয় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মিন এইসটিন কো কো গিকে আটক করা হয়েছে। ইয়াঙ্গুনের এক বাসিন্দা বলেন, আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে আটক করা হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমি বাইরে যেতে পারছি না। ডেটা না থাকায় মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে পারছি না। এটাই এখন এখানকার অবস্থা। তবে মিয়ানমারের কোথাও এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের পার্লামেন্ট উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে। এর ভেতরে পুলিশ ও বাইরে সেনা সদস্যরা অবস্থান করছেন। এদিকে মিয়ানমারের কেউ জানে না সু চি কোথায়। মিয়ানমারের নির্বাসিত নেতারা সু চির মুক্তি চেয়েছেন।
অভ্যুত্থানের পর রাতারাতি মিয়ানমারের মন্ত্রিসভা পালটে গেছে। অং সান সু চি সরকারের ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন ১১ জন শপথ নিয়েছেন। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশ সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা। কয়েকজন রয়েছেন সেনাসমর্থিত দল ইউএসডিপির সদস্য। ইউএসপিডির অন্যতম নেতা উনা মং লউনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। সেনাবাহিনী পরিচালিত টেলিভিশনে নতুন মন্ত্রী নিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়।
অভ্যুত্থানের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং তার সঙ্গে আটক মন্ত্রিপরিষদের বাকি সদস্যদের অবস্থান জানা যায়নি। তবে এমপিরা নেপিদোর আবাসিক কমপ্লেক্সেই গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। একজন এমপি জানান, তিনিসহ চার শতাধিক আইনপ্রণেতা নেপিদোর আবাসিক কমপ্লেক্সে বন্দি রয়েছেন। তারা পরস্পরের সঙ্গে এবং ফোনে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। তবে তাদের ওই আবাসন কমপ্লেক্স থেকে বেরোতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি জানান, কমপ্লেক্সের ভেতরে পুলিশ এবং বাইরে প্রহরায় সেনা সদস্যরা রয়েছেন। সেখানে সু চির দলসহ অন্য সব ছোটখাটো দলের এমপিদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। জান্তা সরকার তাদেরও ধরে নিয়ে যেতে পারে-এমন আশঙ্কায় নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন তারা।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সোমবার জাতিসংঘ মুখপাত্র স্টেফানে দুজারিক সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার জন ক্যাম্পে বন্দি রয়েছেন। তারা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারেন না এবং মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ একেবারে সীমিত। আমাদের উদ্বেগ হলো-অভ্যুত্থানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। ২০১৭ সালে রাখাইনে সামরিক অভিযানে নিপীড়নের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এখন তারা বিভিন্ন শিবিরে বাস করছেন।
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। বৈঠকটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এ বৈঠকের বিষয়টি অনুমোদন করেন। বৈঠকে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ও সুইজারল্যান্ডের কূটনীতিক ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গেনার পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ: সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করায় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি আঘাত বলে আখ্যা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল বদলে দেওয়া বা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কখনো যাওয়া উচিত নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যখনই কোথাও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে তার মোকাবেলা করবে।
ইইউ কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমার সেনা নিয়ন্ত্রণে থাকলে অবশ্যই দেশটি কালো তালিকাভুক্ত থাকবে। দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। অগণতান্ত্রিক শাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ইইউ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। এদিকে, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে চীন দেশটির সব পক্ষকে মতপার্থক্য কাটিয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছে। কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে অভিহিত করেছে।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজনীতিকদের আটকের নিন্দা জানিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অভ্যুত্থানের ঘটনায় লন্ডনে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিও জাওয়ার মিনকে তলব করা হয়েছে। অং সান সু চিসহ দেশটির বেসামরিক নেতাদের আটকের নিন্দা জানান এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী নাইজেল অ্যাডামস। আটক নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More