মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস কাল

মহাসিন আলী/শেখ শফি: বাঙালির গৌরবময় দিন ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। দিবসটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিনে মুজিবনগর (তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলা) আম্রকাননে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ করা হয়। যার মাধ্যমে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি জনতার আত্মত্যাগের সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি করে বীরত্বপূর্ণ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমাদের দেশবাসী প্রতিষ্ঠা করেছিলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে কারণে দিনটি প্রতিটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর আম্রকাননের যে স্থানটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ হয়; সেই স্থানে ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে স্মৃতিসৌধ। যা বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নামে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাস খুঁজতে সারা বছর মুজিবনগরে লোক সমাগম হয়ে থাকে। অনেকে দেখতে আসেন; অনেকে জানতে আসেন। কিন্তু মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের কোন কোন ইতিহাস আছে তা এখনো অনেকের অজানা রয়েছে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়। এর প্রায় ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আবার সেই তৎকালীন প্রাচীন ভারতের নদীয়া জেলার আর এক অংশে বর্তমানে মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে স্বগর্বে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য। এর পর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেন। এরপর স্বাক্ষী হিসেবে স্বাধীন বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধরে রাখতে গড়ে তোলা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ।

১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর স্মৃতি মিউজিয়ামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম। একই দিনে বঙ্গবন্ধু তোরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনছুর আলী। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ এবং রেস্ট হাউজ নির্মাণ করেন। স্মৃতিসৌধের উত্তর-পশ্চিম পাশে একটি দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে কোন কোন স্মৃতি নিয়ে স্মৃতিসৌধের ইতিহাস তা তুলে ধরা হয়েছে। নিচের তথ্যগুলো মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে দর্শকদের সঠিক ধারণা দেবে।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে লাল মঞ্চ: এটি স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের স্থানে ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত সিরামিক ইটের তৈরি আয়তকার লাল মঞ্চটিকে স্থান দেয়া হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের মূলভীতের মাঝখানে। যেখানে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

২৩টি স্মৃতিস্তম্ভ: স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য হতে বিচ্ছুরিত ২৩ রশ্মির শেষাংশ দ্বারা ২৩ স্তম্ভ বোঝানো হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্থানী শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিক। দেওয়াল গুলোর প্রথমটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটির দেওয়াল ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ এক ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বেড়ে গেছে। যার অর্থ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিলো। শেষ দেওয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। প্রতিটি দেওয়ালে ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে। যেগুলো পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

এক লাখ বুদ্ধিজীবীর মাথার খুলি: স্মৃতিসৌধের ভূতল থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উচু বেদীতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত দ্বারা এক লক্ষ বুদ্ধিজীবীর খুলি বোঝানো হয়েছে।

৩০ লাখ শহীদ: স্মৃতি সৌধের ভূ-তল থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীতে অসংখ্য পাথর দ্বারা ৩০ লাখ শহীদ ও মা-বোনের সম্মানের প্রতি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও স্মৃতিচারণ প্রকাশ করা হয়েছে। পাথরগুলোর মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন (পূর্ব বাংলার যা পূর্ব পাকিস্থান নামে পরিচিত ছিলো) ১৯ টি জেলা বোঝানো হয়েছে।

১১টি সিঁড়ি: স্মৃতিসৌধে আরোহনের জন্য ১১টি সিঁড়ি রয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধকালীন সমগ্র বাংলাদেশকে  ১১টি সেক্টরে বিভিক্ত করা হয়েছিলো তা বোঝানো হয়েছে।

সাড়ে ৭ কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতা: লাল মঞ্চ ও ২৩ টি দেওয়ালের মাঝে অসংখ্য নুড়িপাথর মোজাইক করা আছে। এটা সাড়ে ৭ কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতার প্রতীক।

রক্তের সাগর: পশ্চিম পাশে স্মৃতিসৌধের  প্রথম দেওয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ বয়ে গেছে। যাকে রক্তের সাগর বলা হয়।

২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীক: স্মৃতি সৌধের প্রধান ফটক থেকে যে রাস্তটি মূল স্মৃতি সৌধ্যের রক্তের ঢালকে স্পর্শ করেছে। সে রাস্তাটি ভাষা আন্দোলনের বা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ রাস্তায় সকল প্রকারযান চলাচল নিষিদ্ধ।

বঙ্গোপসাগর: স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশের আমবাগান ঘেষা যে স্থানটি মোজাইক করা রয়েছে তা দ্বারা বঙ্গোপসাগর বোঝানো হয়েছে। যদিও বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণে তবুও শপথ গ্রহণের মঞ্চটির সাথে সামাঞ্জস্য রক্ষার জন্য এটিকে উত্তরে স্থান দেয়া হয়েছে।

এদিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আমাদের মুক্তিযদ্ধের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ নতুন প্রজন্ম ও বিশ^বাসীর কাছে তুলে ধরতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মুজিবনগর কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছেন। যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পাঠাগার অন্যতম।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More