রিকশাচালক থেকে নাচের শিক্ষক : আড়ালে শতাধিক নারী পাচার : রুট চুয়াডাঙ্গা

স্টাফ রিপোর্টার: কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল (৩৭)। ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। পরে একটি বেসরকারি কোম্পানির পণ্য ডেলিভারি ভ্যানের চালক হিসেবে চাকরি নেন। কয়েক বছর পর একটি ‘ড্যান্স’ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর হাতিরঝিল এলাকায় নিজেই গড়ে তোলেন একটি ড্যান্স ক্লাব। উঠতি বয়সী মেয়েদের নাচ শিখিয়ে বিনোদন জগতের রঙিন স্বপ্ন দেখাতেন তিনি। পরে সেই তরুণীদের ভারতে পাচার করে দিতেন। আর এই পাচার কাজ করতে গড়ে তোলেন একটি চক্র। এই চক্রটি এ পর্যন্ত শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে দাবি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব)। বিদেশে পাচারের আগে তরুণীদের নিজেদের ‘সেইফ হাউজে’ আটকে রাখতো মানবপাচারকারীরা। এরপর সুবিধামত সময়ে তাদের পাচার করে দেয়। এমন ২৩ তরুণীকে সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে দুটি চক্রের সেইফ হাউজে রাখা হয়েছিলো। তবে পাচার হওয়ার আগেই গত শুক্রবার রাতে তাদের উদ্ধার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৪। একইসঙ্গে মানবপাচারকারী দুটি চক্রের দুই হোতাসহ ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। শনিবার র‌্যাব-৪ এর মিরপুর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল ফোন, আট বোতল বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার এবং মানবপাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে। ওই দুই চক্রের মধ্যে কামরুল একটি চক্রের হোতা। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের দাবি, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার করে এমন দুটি চক্রের সন্ধান পায় তারা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সম্প্রতি ২৩ নারীকে পাচারের প্রক্রিয়া করছিলো এই দুটি চক্র। একটি চক্রের নেতৃত্ব দেন ড্যান্স কামরুল। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ভারতে মানবপাচার করেন তিনি। কামরুলসহ তার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- চাঁদপুরের রিপন মোল্লা (২২), গাজীপুরের আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০) ও ঝিনাইদহের নাইমুর রহমান ওরফে শামীম (২৫)। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, কামরুল কুমিল্লা থেকে ২০০১ সালে ঢাকায় আসেন। কর্মজীবন শুরু করেন রিকশাচালক হিসেবে। কিছুদিন একটি বেসরকারি কোম্পানির পণ্য ডেলিভারি ভ্যানের চালক ছিলেন। কয়েক বছর চাকরির পর একটি ‘ড্যান্স’ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে হাতিরঝিল এলাকায় নিজেই গড়ে তোলেন ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব। উঠতি বয়সী মেয়েদের নাচ শিখিয়ে বিনোদন জগতের রঙিন স্বপ্ন দেখানো হতো। পরে সেই তরুণীদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করতেন কামরুল ও তার চক্র। এই চক্রটি এ পর্যন্ত শতাধিক নারীকে পাচার করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, কামরুল বেশ কয়েকবার পার্শ্ববর্তী দেশে ভ্রমণ করেন। সেখানকার নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার ড্যান্স ক্লাবের এক নারীকে পার্শ্ববর্তী দেশের বিউটি পার্লারে অধিক বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করেন। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগীর বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড্ডা থানা পুলিশ তাকে আটক করে। তিন মাসে কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজ শুরু করেন। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, কামরুলের চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য সক্রিয় রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি মানবপাচার করে আসছে। বিভিন্ন জেলা থেকে উঠতি বয়সী মেয়েদের নানা প্রলোভনে ঢাকায় আনা হয়। তাদের বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। পরে তাদের ভারতে চাকরির কথা বলে পাচার করতো। এর আগে পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেইফ হাউজে তাদের রাখা হতো। পরবর্তীতে সেইফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দিতো। অপর চক্র সম্পর্কে র‌্যারবের দাবি, বনানী, পল্লবী, উত্তরা ও তেজগাঁও থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের হোতা লক্ষ্মীপুরের নুর-নবী ভূইয়া রানা (৪৪)। রানাসহ তার চক্রের সদস্য নোয়াখালীর আবুল বাশার (৫২), লালমনিরহাটের আল ইমরান (৪১), কুমিল্লার মনিরুজ্জামান (৩৫), প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২) পিরোজপুরের শহিদ সিকদার (৫৪) ও গোপালগঞ্জের টোকনকে (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রানা লক্ষ্মীপুরের একটি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে ওমানে যান শ্রমিক ভিসায়। ওমানে থাকা অবস্থায় মানবপাচার চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন থেকেই মানবপাচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দেশে ফিরে নিজেই একটি চক্র গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার শুরু করেন। তার চক্রে দেশে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এ পর্যন্ত চক্রটি ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেইফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশকয়েকদিন ওইসব সেইফ হাউজে ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করতো।
উল্লেখ্য, ভারতে পাচারের পর গত মে মাসে বাংলাদেশের এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরপরই মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More