শুকায়নি নির্বাচনী সহিংসতায় ঝরা রক্তের দাগ : গ্রামে পুলিশের পাহারা

গাংনীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর ধলা গ্রামের জোড়া খুনের ঘটনায় মামলা দায়ের
গাংনী প্রতিনিধি: গাংনী উপজেলার লক্ষ্মীনারায়ণপুর ধলায় গ্রামে দুপক্ষের সংঘর্ষে দুই ভাইকে হত্যাকা-ের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে ওই গ্রামের এক পক্ষের নেতা আতিয়ার রহমানকে। নিহতের ভাই বেল্টু মিয়া বাদী হয়ে গাংনী থানায় মঙ্গলবার রাতে মামলাটি দায়ের করেন
গাংনী থানাসূত্রে জানা গেছে, জাহারুল ও শাহাদুল ইসলাম হত্যা মামলায় প্রধান আসামি আতিয়ার রহমান ছাড়াও আরও ৬৬ জনের নাম রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে জোর প্রচেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। তার পাশেই জনাদশেক পুলিশ পাহারায়। পাকা সড়ক পেরিয়ে বড় একটি পুকুরসংলগ্ন কাঁচা সড়কের পাশে সহিংসতায় নিহত দুই ভাই জাহারুল (৪৭) ও সাহাদুলের (৪৩) পাশাপাশি বাড়ি। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তাদের বাড়িতে ঢুকতেই জাহারুলের মা জাহেরা খাতুনকে বিলাপ করতে দেখা গেলো। ছেলেদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তিনি এখনও খাবার স্পর্শ করেননি। জাহেরা খাতুনের ৬ মেয়ে; ছেলে ওই দুটিই। দুই ছেলেকেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত সোমবার ঘটনার পরপরই ৬ মেয়ের সবাই বাড়িতে এসেছেন। বাড়ির বাইরে থেকে তাদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতায় দুই ভাই নিহতের ঘটনায় গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে সংঘর্ষের পর থেকে ঢাকা দিয়েছে আতিয়ার রহমানসহ তার পক্ষের লোকজন। আতিয়ার রহমান গাংনী উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক। ধলা গ্রামের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য আজমাইন হোসেন টুটুলের সাথে তার দীর্ঘদিনের বিরোধ। বৃহস্পতিবার গাংনী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। কাথুলী ইউনিয়নের ৭নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান মেম্বার আজমাইন হোসেন টুটুল ও কৃষক লীগ নেতা আতিয়ার রহমান মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পূর্ব বিরোধের জের ধরে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রভাব পড়ে। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ওই গ্রামে দু’পক্ষের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে শেষ হয়। সোমবার সকালে আজমাইন হোসেন টুটুল গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে ভোট চাইতে গেলে আতিয়ার রহমান ও তার পক্ষের লোকজন অতর্কিত হামলা চালায়। টুটুলকে বাঁচাতে গিয়ে উপর্যুপরি ধারালো অস্ত্রের কোপের শিকার হন তার আপন মামাতো ভাই জাহারুল ইসলাম ও সাহাদুল ইসলাম। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। রক্তক্ষয়ী তুমুল সংঘর্ষের পর স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে এক অন্য পরিবেশ বিরাজ করছে। আতিয়ার পক্ষের লোকজন আত্মগোপনে রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, কাথুলী ইউনিয়নের ৭নং লক্ষ্মীনারায়ণপুর ধলা গ্রামের ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করছেন বর্তমান ইউপি সদস্য আজমাইন হোসেন। তার মামাতো ভাই নিহত জাহারুল ও সাহাদুল। একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আতিয়ার রহমান নামের একজন। আতিয়ার গাংনী উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক। আজমাইন ও আতিয়ার দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে তাদের বিরোধ চরমে পৌঁছায়। নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে গত রোববার দুজনের মধ্যে বাগবিত-া হয়। এর জেরে সোমবার সকালে আতিয়ার ও তার সমর্থকেরা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আজমাইন হোসেনের সমর্থকদের ওপর হামলা করেন। এ সময় আজমাইনের মামাতো দুই ভাই ধারালো অস্ত্রের কোপে ঘটনাস্থলে নিহত হন, আহত হন আরও ২০ জন। এতে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ২০জন গুরুতর আহত হন। আহতরা গাংনী, কুষ্টিয়া ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন আরও জানান, গ্রামে দুটি পক্ষের মধ্যে একযুগ ধরে বিরোধ চলছে। এ বিরোধের জেরে আগেও একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় ধলা বিল নিয়ে বিরোধের প্রথম সূত্রপাত হয়। বিল দখলকে কেন্দ্র করে ২০০০ সালে সাইদুল হোসেন নামের একজন খুন হন। পরে এর জেরে ২০১৭ সালে এনামুল হোসেন নামের একজনকে প্রতিপক্ষ আতিয়ার রহমানের সমর্থকেরা একটি বাঁশবাগানে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় গাংনী থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। ওই মামলার প্রধান আসামি আতিয়ার রহমান, সম্প্রতি তিনি জামিনে বের হন।
১০০ গজের মধ্যে আতিয়ার রহমান ও আজমাইন হোসেনের বাড়ি। প্রতিবেশীরা জানান, ঘটনার পর থেকে আতিয়ার ও তার কর্মী-সমর্থকেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকের বাড়িতে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। তবে অনেক বাড়িতে শুধু নারী সদস্যরা রয়েছেন। রাতে পুলিশ পাহারা থাকার কারণে কারও বাড়িতে লুটপাট হয়নি।
আতিয়ারের বড় বোন টোটন আরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দুইপক্ষের বিরোধে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে আছে। রাত হলেই গরু-ছাগলসহ আসবাবপত্র লুট হওয়ার আশঙ্কায় নারীরা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেনি।
এদিকে নিহত দুই সহোদরের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার রাতেই নিজ গ্রামে দাফন হয়েছে। একই সাথে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে অসহায় হয় পড়েছে তাদের পরিবারের সদস্যরা। পরিবার এবং স্বজনদের মাঝে চলছে শোকের মাতম। সংঘর্ষের পর থেকে গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেকোনো প্রকার সহিংসতা এড়াতে পুলিশ প্রহরা অবসান হয়েছে বলে জানায় গাংনী থানার একটি সূত্র। ধলা পুলিশ ক্যাম্পের একটি টিম সার্বক্ষণিক গ্রামে দায়িত্ব পালন করছে। ভোট গ্রহণ কেন্দ্র করে নতুন করে কোন প্রকার সহিংসতা যাতে না হয় সেদিকে সজাগ রয়েছে পুলিশ প্রশাসন।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিরুল ইসলাম জানান, সোমবার রাতে লাশ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করলে পুলিশি পাহারায় এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটজনকে আটক করেছে পুলিশ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More