শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিলো ট্রাইব্যুনাল
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ : সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন চিফ প্রসিকিউটরের
স্টাফ রিপোর্টার: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। হাসিনা ছাড়াও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধেও। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্মূলের নির্দেশ ও ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়সহ পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুন পরোয়ানা-সংক্রান্ত তামিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। ঐদিন মামলার গ্রেফতারকৃত আসামি মামুনকে কারাগার হতে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে বলা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রবিবার এই আদেশ দেয়। মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনসহ পুরো বিচার প্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। এর মধ্য দিয়ে দেশের কোনো আদালতের বিচার প্রক্রিয়া এই প্রথম সম্প্রচার করা হলো। এর আগে তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৪ জুলাই রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আসামি কামাল ও চৌধুরী মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটন করেছেন। এছাড়া অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ করেছেন আসামিরা। যা তাদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, চানখাঁরপুলে আন্দোলনকারী ছয় ছত্র-জনতাকে হত্যা এবং ঢাকার আশুলিয়ায় আন্দোলনকারী পাঁচ জনকে গুলি করে হত্যার পর তাদের মরদেহ এবং এক জন আহতকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। অভিযোগ উপস্থাপনের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির প্রার্থনা করেন চিফ প্রসিকিউটর। আসামিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা যেন ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয় সেই আর্জি জানান তিনি। এরপরই ট্রাইব্যুনাল পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়। চিফ প্রসিকিউটর ছাড়াও প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার ও প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনান। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনকালে আওয়ামী লীগ কর্তৃক রক্ষী বাহিনী গঠন করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা ও নির্যাতন, শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাকশাল কায়েম, শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে পরপর বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, পিলখানা হত্যাকা-, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে হত্যাকা-, বিরোধী মত দমনে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীদের হামলা, গুলি, নারী নির্যাতনসহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চিত্র তুলে ধরা হয়। এ সময় প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ, গাজী এম এইচ তামিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। ২৪-এর আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিগণ কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকা- ও ভয়াবহ সহিংতার শিকার হন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। যা দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তিনি বলেন, এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে—সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।
প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংঘটনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ, আসামিগণের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস, ডিজিটাল এভিডেন্সসমূহের ফরেন্সিক রিপোর্ট, আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়েছে। মামলায় ৮১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ১৩৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগসহ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার দালিলিক তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। আছে শহিদদের তালিকা।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ দাখিল হয়। গত ১২ মে তিন জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয় গতকাল।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.