সারাদেশে আজ শুরু হচ্ছে টিকাদান বিশেষ কর্মসূচি : টিকা পাবেন ৩২ লাখ মানুষ

করোনা টিকাদানে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাড়াচ্ছে চ্যালেঞ্জ
স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নির্ধারিত সময়ে কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম শুরুর দাবি করার পরও বিভিন্ন সময় কর্মপরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ফলে মহামারি নিয়ন্ত্রণে নানা আশ্বাসের পরও বারবার হোঁচট খাচ্ছে সরকারের গৃহীত কর্মকান্ড। অন্যদিকে শত প্রস্তুতি সত্ত্বেও দিন দিন বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে এক মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার ঘোষণা দিলেও কয়েক দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গণটিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার সর্বশেষ লক্ষ্য ঠিক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে টিকাদান কেন্দ্র সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত ২৫ বছরের উর্দ্ধে ব্যক্তিদের প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হবে। আজ সকাল ৯ টার দিকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডের রিজিয়া খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ক্যাম্পেইন উদ্বোদন করবেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বে টিকা আবিষ্কারের পর বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা ক্রয়, মানুষকে টিকার আওতায় আনা এবং টিকাদান ব্যবস্থাপনা- এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে না পারায় স্বাস্থ্য বিভাগকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। ইতিপূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনিক ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও সেটি অর্জন করতে পারেনি। এরই মধ্যে গত ২৫ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার কথা জানান। এরপর ১ আগস্ট জানান, এক সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এ লক্ষ্যে গত বুধবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় ৭ থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে গণটিকাদান কর্মসূচির আওতায় এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার ঘোষণা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সরকার এক সপ্তাহের পরিবর্তে মাত্র একদিন এ কর্মসূচি চালাবে বলে জানায়। সর্বশেষ শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশব্যাপী এই কর্মসূচির মাধ্যমে ৬ দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
গণটিকা প্রয়োগের ব্যাপারে একাধিক জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগ ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ১০ ধরনের টিকা দিচ্ছে। টিকাদানে সফলতায় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের আলাদা পরিচিতিও রয়েছে। ফলে এক কোটি নয়, দৈনিক দুই কোটি টিকা দেয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের। তবে চলমান করোনা টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, টিকাদান ও মানুষের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো। এমন পরিস্থিতিতে মহামারি মোকাবিলায় এক মাস বা এক সপ্তাহে এক কোটি মানুষের টিকা প্রয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
এদিকে আজ শনিবার সারাদেশে ৪ হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন, ১ হাজার ৫৪টি পৌরসভা, ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৩৩টি ওয়ার্ডে এই বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি চলবে। ১৫ হাজারের বেশি টিকাদান কেন্দ্রে ৩২ হাজার ৭০৬ জন টিকাদানকারী এবং ৪৮ হাজার ৪৫৯ জন স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচিতে যুক্ত থাকবেন। এসব কেন্দ্রের বিপরীতে আগাম নিবন্ধনের ভিত্তিতে বয়স্ক, অসুস্থ, নারী ও প্রতিবন্ধীরা সুযোগ পাবেন। তবে প্রান্তিক পর্যায় অর্থাৎ ইউনিয়ন ও উপজেলায় করোনা টিকা প্রদানের চ্যালেঞ্জের প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, এর আগে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভারতীয় কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ প্রয়োগ শুরু হয়েছিলো। সরবরাহ সংকটে মাঝপথে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার নির্ধারিত সময় পার হওয়ায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ উৎকণ্ঠায় পড়েন। এ ছাড়া রাজধানীতে বিদেশগামী প্রবাসীদের টিকা দেয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ঝামেলা হওয়া ও ফাইজারের টিকার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় বাকিদের সিনোফার্মের টিকা দিতে গিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। ফাইজারের টিকা নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ঘাটতিতে শুধু রাজধানীতে টিকা কেন্দ্র করা হয়। ওই সময় কঠোর লকডাউন চলাকালে দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকার নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়ে অনেক প্রবাসীকে বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা যায়।
এরই মধ্যে ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদানের ঘোষণার পরদিনই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে করোনা টিকা দেওয়া শুরু হয়। ১ আগস্ট টাঙ্গাইলের একটি কেন্দ্রে ৩০ জনের শরীরে টিকা পুশ না করেই তা ফেলে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। ৩ আগস্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের করোনা টিকাকেন্দ্রে ছাত্রলীগের এক নেতার সঙ্গে বিতন্ডার জেরে ওই হাসপাতালের ৮টি কেন্দ্রে প্রায় ৩ ঘণ্টা টিকাদান বন্ধ হয়ে যায়। পাবনাতেও টিকাদানের নামে খালি সূচ ফুটানোর অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া এ কার্যক্রমে গণমানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রান্তিক পর্যায়ে টিকাদান ব্যবস্থাপনায় ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে প্রতিদিন অনেক কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে টিকা নিতে মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এতে করে উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়লেও নজরদারি নেই।
এদিকে ফের গণটিকা দিতে ৭ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় নিবন্ধন শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ দিনে টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন ৫৪ লাখের কিছু বেশি মানুষ। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন নিবন্ধন করছেন ৩ লাখের মতো মানুষ। টিকাদান শুরুর পর এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮৮ হাজার ডোজ টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৪৪ জনকে প্রথম ডোজ এবং ২৭ হাজার ৩৮৬ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কেনা ও বিভিন্ন মাধ্যমে উপহার মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৪ হাজার ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৫ কোটি মানুষের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চায় সরকার। আগামী বছরের শুরুতে ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। টিকা পাওয়ার এমন আশ্বাসে মাসে ১ কোটি টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সে অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ৩ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষকে টিকা দিতে হবে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকাতে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে সরকার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এখন পর্যন্ত ১ কোটি ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৭ জনকে প্রথম ও ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৭ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে।
সরকারের টিকাদান টাস্কফোর্স বলছে, দেশে ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকা দিতে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডোজ লাগবে। আর ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে লাগবে প্রায় ২০ কোটি ডোজ টিকা। এখন যে হারে টিকা দিচ্ছে, তাতে এই বছর নাগাদ ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, দেশের উপজেলা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত যে নেটওয়ার্ক রয়েছে, টিকার সরবরাহ ঠিক থাকলে বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ বেশি টিকা দেওয়া সম্ভব। এজন্য দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জনগণের টিকা গ্রহণের ইচ্ছা। যে হারে টিকা আসছে, এখনো নিবন্ধন সেভাবে হচ্ছে না। সমন্বিতকরণের জন্য শুধু সরকারি প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়, সমাজকর্মী, এনজিও ও অন্যান্য সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে। টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সময়মতো কেন্দ্রে টিকা সরবরাহ ও সরংক্ষণ, মানুষের সম্পৃক্ততা এবং প্রয়োগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব না দিলে নিশ্চিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More