সিলেটে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮ জন নিহতের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার সন্তান ডা. ইমরান : স্ত্রী ডা. অন্তরা আইসিইউতে

স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত চুয়াডাঙ্গার সন্তান ডা. ইমরান খান রুমেলের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার বাদ আসর হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার মসজিদে নামাজের জানাজা শেষে মানিক পীর (রহ.) কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ডা. ইমরান খান চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের সন্তান হলেও তার পিতা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. আমজাদ হোসেন খান দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে বসবাস করছেন। পরিবারসহ তারা সিলেটের সিলেটের ফাজিলচিশত এলাকার সুবিদবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
এদিকে, দুর্ঘটনায় আহত ডা. ইমরান খান রুমেলের স্ত্রী ডা. শারমিন আক্তার অন্তরার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে তার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়, পরে রাতে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। গতকাল শনিবার সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) চিকিৎসক ডা. সোহেল আহমদ সরকার।
এছাড়া সিলেটের রশিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত ও আহত হন অন্তত ১৮ জন। আহতদের মধ্যে সিলেটের এমএজি ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৫ জন। তাদের সকলের অবস্থায় এখন ঝুঁকিমুক্ত। তবে এদের মধ্যে ৩ জনের হাতে ও পায়ে একাধিক ভাঙা থাকায় তাদের অবস্থা কিছুটা গুরুতর বিবেচনায় রেখেছেন চিকিৎসকরা।
অপরদিকে, শুক্রবারের এ দুর্ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। মামলাটি করেন থানার উপ-পরিদর্শক এসআই লোকমান হোসেন। আরা মামলায় আসামি করা হয়েছে বাস দুইটির চালককে। যদিও তারা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। একইসাথে ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি আর্থিক পরিমাণও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডা. ইমরান খান রুমেল সিলেটের উইমেনস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক আর স্ত্রী শারমিন আক্তার অন্তরা একই কলেজে ইন্টার্ন চিকিৎসক এবং ৪২তম বিসিএস পরীক্ষার্থী। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টায় ঢাকায় ছিলো বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। পরীক্ষায় অংশ নিতে দুই মেয়েকে সিলেটে রেখে সকাল সোয়া ছয়টায় বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন চিকিৎসক দম্পতি শারমিন আক্তার ও ইমরান খান। তবে সিলেট থেকে রওনা হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশীদপুরে তাদের বহন করা এনা পরিবহনের বাসের (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-৭৩১১) সঙ্গে ঢাকা থেকে সিলেটমুখী লন্ডন এক্সপ্রেস বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব ১৫-৩১৭৬) মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ডা. ইমরানসহ ৮ জন। আহত হন শারমিন আক্তারসহ অন্তত ১৮ জন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান চিকিৎসক দম্পতির পরিবারের সদস্যরা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত চিকিৎসক ইমরান খান রুমেল (৩৬) সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক আমজাদ হোসেন খানের ছেলে। তিনি জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১২ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকে এমবিবিএস পাসের পর তিনি উইমেন্স মেডিকেল কলেজে চাকরি জীবন শুরু করেন। প্রায় সাত বছর আগে শারমিন আক্তারের সঙ্গে ইমরানের বিয়ে হয়। তাদের সাড়ে চার বছর বয়সের ইনায়া খান ও তিন বছরের ইন্তেয়া খান নামের দুটি সন্তান আছে। তাদের সিলেটের বাসায় রেখে বিকেলের বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে শারমিন স্বামীর সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেছিলেন। এ কারণে বেঁচে গেছে দুই সন্তান। পিতা-মাতার সঙ্গে থাকলে তাদের জীবনেও নেমে আসতো সমূহ বিপদ।
ডা. ইমরানের প্রতিবেশী এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান ডা. মমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই দুর্ঘটনায় তারা শোকাহত হয়ে পড়েছেন। ডা. ইমরান একজন ভালো লোক ছিলেন। তিনি সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করতেন। তার মৃত্যুতে চিকিৎসক সমাজও শোকাহত। ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক সিলেটের সিনিয়র চিকিৎসক আমজাদ হোসেন। খবর পেয়েই ছুটে আসেন হাসপাতালে। ছেলে মারা গেছে, পুত্রবধূ সংকটাপন্ন। এ কারণে তিনি পুত্রবধূর জীবন রক্ষায় হাসপাতালেই রয়েছেন।
এনা পরিবহনের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন, রশিদপুরে বিপরীত থেকে আসা ঘাতক লন্ডন এক্সপ্রেসের বাসটি তাদের বহনকারী এনা পরিবহনের বাসকে আঘাত করে। স্ত্রীর অন্তরার পাশে বসা ছিলেন ডা. ইমরান। দুর্ঘটনায় তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত হন ডা. অন্তরা। দুর্ঘটনার পর পরই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে শরীর থেকে। এনা পরিবহনের গাড়ির সামনের অংশের এক পাশে বসা ছিলেন তারা। এ কারণে দুর্ঘটনার সময় দু’জনই বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হন। তারা বলেছেন, দুর্ঘটনার পর তারা সাহায্যের জন্য চিকিৎকার করছিলেন। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও তারা খালি হাতে কাউকে বের করতে পারছিলেন না। শেষে হাতুড়ি, লাঠি দিয়ে গ্লাস ভেঙে তাদের বের করা হয়। তার আগেই সামনে যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রক্তক্ষরণের কারণে কারো কারো শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তেমনই একজন ছিলেন ডাক্তার ইমরান। দুর্ঘটনায় তার শরীরের একাধিক স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।
এদিকে, অস্ত্রোপচারের পর ডা. অন্তরাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে শনিবার সকালে জানিয়েছেন ইউনিটের চিকিৎসক ডা. সোহেল আহমদ সরকার। তিনি বলেন, সকালে ডা. অন্তরার মুখে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। তিনি সুস্থ রয়েছেন। তবে বার-বার তিনি তারা স্বামীর খোঁজ করছেন। তবে স্বজনরা তার স্বামী অন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বলেও জানালেও তিনি তা মানতে নারাজ। তিনি বলছেন ‘আমি সব জানি’। স্বজনরা অন্তরাকে তার স্বামীর মৃত্যুর খবর না জানানো হলেও তিনি আঁচ করতে পেরেছেন যে তার স্বামী ইমরান আর বেঁচে নেই।
সিলেটের রশিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এমএজি ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও ১৫ জন। তাদের সকলের অবস্থায় এখন ঝুঁকিমুক্ত। তবে এদের মধ্যে ৩ জনের হাতে ও পায়ে একাধিক ভাঙা থাকায় তাদের অবস্থা কিছুটা গুরুতর বিবেচনায় রেখেছেন চিকিৎসকরা। এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সকলেই স্বাভাবিক আছেন। তবে ৩ জনের হাত পায়ের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ভাঙ্গা থাকায় অবস্থা গুরুতর বিবেচনা করা হচ্ছে। আর বাকিদেরে ছোটখাটো জখম আছে। গুরুতর ৩ জনের মধ্যে নিহত ডা. ইমরান খানের স্ত্রীকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। তবে তার আইসিউ সাপোর্ট লাগছে না। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ কয়েকটি কারণে তাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য আইসিউতে রাখা হয়েছে।
রুমেলের দাফন সম্পন্ন: শুক্রবার বাদ আসর হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার মসজিদে নামাজের জানাজা শেষে মানিক পীর (রহ.) কবরস্থানে ডা. ইমরান খান রুমেলের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। জানাজায় চিকিৎসক মহলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
শোক: সম্ভাবনাময় তরুণ চিকিৎসক ডা. ইমরান খান রুমেলের ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানি হলি সিলেট হোল্ডিং লিঃ এর কর্মকর্তাবৃন্দ। মরহুমের মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা। একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় নিহত সকলের মাগফেরাত কামনা ও ডা. ইমরান খান রুমেলের স্ত্রী ডা. অন্তরাসহ আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তারা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More