হঠাৎ আকাশ থেকে ছুটে আসা একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে আছড়ে পড়লো স্কুলের মূল গেটের সামনে স্কুলের কক্ষগুলোতে ঢুকে পড়লো আগুনের লেলিহান শিখা ; নিহত অন্তত ২০ : আজ রাষ্ট্রীয় শোক হাসপাতালে শুয়ে কাতরা”েছ দেড় শতাধিক শিশু ও অভিভাবক : বাতাসে হাহাকার সান্ত¡না মিলবে কিসে
স্টাফ রিপোর্টার: গতকাল সোমবার দুপুর। রাজধানীর দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে তখনো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে তাদের ক্লাসে বসে পড়াশোনা করছিল। প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত ছিল বইয়ের পাতায় চোখ রাখায়। ঠিক সেই সময়, দুপুর ১টা ১৫ মিনিট। হঠাৎ আকাশ থেকে ছুটে আসা একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে আছড়ে পড়লো স্কুলের মূল গেটের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু উল্টেপাল্টে গেল। বিধ্বস্তের সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ংকর বিস্ফোরণ। আগুনের লেলিহান শিখা স্কুলের কক্ষগুলোতে ঢুকে পড়লো। কেবল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তীব্র তাপ ও ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে যেতে থাকল ভেতরে থাকা শিশুগুলো। পিঠে বইয়ের ব্যাগ, হাতে খাতাপত্র নিয়ে যে বা”চারা স্বপ্ন দেখছিলো জীবনের, তারা তখন পুড়ে ছোটাছুটি করছে বাঁচার জন্য। কিš‘ এতটুকু শরীর নিয়ে, এমন ভয়ংকর আগুনের সামনে তাদের আর কিছুই করার ছিলো না। কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ছিলো একের পর এক। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে যখন আহতদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে, তখন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের করিডর যেন কেবল আহাজারির এক সমুদ্র। কারো কপাল পুড়ে গেছে, মাথা ফেটে গেছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতরা”েছ। কেউ বারবার মূর্ছা যা”িছলো। ঘটনা¯’লে অনেকেই ছুটে বেড়া”িছলেন সন্তানদের খোঁজে। কারো কণ্ঠে কোনো সান্ত¡না নেই-কেবল চারপাশে কান্না আর হাহাকার। প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ২০ ছুঁয়েছে। আহত ও দগ্ধ দেড় শতাধিক শিশু ও অভিভাবক হাসপাতালে শুয়ে কাতরা”েছ। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ মিশে গেছে কান্নার শব্দে। ক’জনের সন্তান আর বাড়ি ফিরবে না, ক’জন ফিরলেও আর আগের মতো হাসতে পারবে না এমন প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে। দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় শোকে আ”ছন্ন পুরো দেশ। আজ মঙ্গলবারের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। কিš‘ এ শোক কি মুছে দিতে পারবে সন্তানদের বুকের পোড়া দাগ? কিংবা ক’জন বুকে সান্ত¡না নিয়ে ঘুমাতে পারবে? আজ এই বাতাসে কেবল হাহাকার, আর একটি নির্দয় প্রশ্ন—এ অন্যায় যন্ত্রণার সান্ত¡না মিলবে কিসে?
আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭ বিজিআই’ফাইটার জেটটি সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জহিরুল নামে এক ¯’ানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, উড়োজাহাজটা মাঠে আছড়ে পড়ে। তারপর ছেঁচড়ে ভবনে গিয়ে ধাক্কা খায়। সেখানেই আগুন ধরে যায়।” হায়দার আলী ভবন নামের ওই দুই তলা অ্যাকাডেমিক ভবনে ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস থ্রি থেকে এইটের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হত। স্কুল ছুটির সময় হওয়ায় অনেক অভিভাবকও ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনা¯’লে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, “ওই ভবনে বা”চাদের ক্লাস চলছিলো। আগুনে ভবন থেকে কেউ বের হতে পারেনি। অনেকেই সেখানে দগ্ধ হয়েছে।” দুর্ঘটনা¯’ল থেকে আহত ও দগ্ধদের রিকশা, ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন বাহনে করে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। এক ডজনের বেশি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের পাঠানো হয় হাসপাতালে। তাদের একটি অংশকে প্রাথমিকভাবে ঢাকা সিএমএইচ, উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে নেওয়া হয়। দগ্ধদের অধিকাংশকে পরে পাঠানো হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনা¯’ালে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। আইএসপিআরও পরে জানায়, বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ মোট ২০ জন সেখানে মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ঢাকা সিএমএইচে নিহত ১২ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটে ২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে ২ জন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ২ জন, ঢাকা মেডিকেলে ১, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ১ জনের লাশ আছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজ ভেঙে পড়ার পর আশপাশ থেকে ছুটে এসেছিলেন অনেকে। তারা বলছেন, ঘটনার পর তারা স্কুল মাঠে একজনকে প্যারাসুট দিয়ে নামতে দেখেছেন। ভয়াল আগুনের জন্য তারা শুরুতে কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী কাওসার বলেন, “একটা ফাইটার প্লেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের জুনিয়র ক্যাম্পাস- এখানে ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ছেলেপেলেরা পড়াশোনা করে, ঠিক সেইখানে প্লেনটা পড়ছে ভাই। “আমাদের ছোটো ভাইয়েরা ছিলো, সবাই ছিলো ভাই। ওইখানে বলতে গেলে সবাই পুড়ে গেছে, সবাই ঝলসে গেছে। আমরা ভিতরে গেছিলাম, আগুনের কারণে কাউকে বের করিতে পারি নাই। খুব খারাপ অব¯’া।” দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদমান তানভীর বলেন, “আমরা যখন ক্লাসে ছিলাম, তখন বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হইছে। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি প্রথমে। তারপর হঠাৎ যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করল- তারপর স্যার আসলেন। “১ নম্বর বিল্ডিংয়ে বিমানের কিছু অংশ হয়তো ব্লাস্ট হইছে। বিল্ডিংয়ের সামনে পড়ছে, যার কারণে পুরো বিল্ডিংয়ে আগুন ধরায়ে গেছে। তারপর আমরা বের হইছি। তারপর দেখি ফায়ার সার্ভিস। “পাশেই ফায়ার সার্ভিস আর পাশেই আর্মি ক্যাম্পও ছিলো। যার কারণে সবাই দ্রুত চলে আসছে। আগুন নিভাইতে বেশি সময় লাগেনি, কিš‘ ভেতরে অনেক মানুষ ছিল। ছোট বা”চারা ছিলো। ওদেরকে বের করতে অনেক সময় লাগে।” স্কুলের পাশেই বাসা লতিফা বেগমের। তিনি বলেন, তার ভাতিজি ক্লাস সিক্সে পড়ে। “ক্লাসে শেষে সবে সে বাসায় ফেরে। আর অন্য বা”চারা কোচিংয়ের জন্য ওই ভবনের সামনে অপেক্ষা করছিল। আর তখনই ঘটনা ঘটে।” স্কুল ভবন থেকে ১০০ গজের মধ্যে মোহাম্মদ জইমত আলীর এক্সক্যাভেটর মেরামতের গ্যারেজ। চালক আপন আহমেদ কাজ করছিলেন। উড়োজাহাজ খুব নিচু দিয়ে উঠতে দেখে তারা দুজনে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই বিকট শব্দ শুনে তারা প্রথমে ছুটে যান পাশের মেট্রোরেলের ডিপোর দিকে। পরে তারা দেখেন, স্কুল থেকে আগুন বের হ”েছ। জইমত আলী বলেন, “আমরা গিয়ে দেখি, একজন প্যারাসুট নিয়া নামছে। আর বহু বা”চা আর তাদের গার্ডিয়ানরা আগুনে পুড়ছে। সবাই ধরাধরি করে তাদের সেখান থেকে সরায়ে আনার চেষ্টা করে। “কিš‘ আগুনের তাপ ছিলো সাংঘাতিক। স্কুলের ওই বিল্ডিংটার ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় ছিলো না। ওটার ভেতরে যারা ছিল, তাদের কী অব¯’া তা জানি না।” ভেকু চালক আপন আহমেদ বলেন, “এক জায়গায় দেখি ১০-১৫ টা বা”চা ডলা হয়ে পইড়ে রইছে। তাদের উদ্ধার করার কোনো উপায় আমাদের ছিল না। “এসব বা”চাদের বের করা হয়েছে, তারাও সব পুড়ে গেছে। জামা-কাপড় ব্যাগ সব পোড়া।” আপন বলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনা¯’লে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন চলে আসে। ঢাকায় যে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ ১৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে, সেই যানের পাইলট ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ করেছিলেন বলে আইএসপিআরের ভাষ্য। সং¯’াটি বলছে, নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। এরপর যানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। দুর্ঘটনা মোকাবেলায় ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম যুদ্ধবিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নেয়ার ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ করেন। তবে ‘দুর্ভাগ্যবশত’ যানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। আইএসপিআর বলছে, দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে বিমান বাহিনী একটি উ”চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার বিস্তারিত জানানো হবে। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে সাইরেন বাজিয়ে, সেগুলোকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যা”েছ সামরিক যান। বাশি ফুঁয়ে ভিড় সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এর মাঝেই এক নারী চিৎকার করতে করতে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। ফোনের ওপাশে ব্যক্তিকে কাঁদতে কাঁদতে বার বার জিজ্ঞেস করছেন ‘মিস আমার বা”চা কই’। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সন্তানের খোঁজে অভিভাবক ও স্বজনরা ছুটে আসেন মাইলস্টোনে। মোবাইল ফোনে শিক্ষকের কাছে সন্তানের খোঁজ করা ওই নারী তাদেরই একজন। তিনি যখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন তখন স্কুল ফটকে জড়ো হওয়া ¯’ানীয়রা তার সন্তানের এবং ক্লাসের নাম জানতে চান। তিনি বলেছেন তার ছেলের নাম সাজ্জাদ সাদী, ছেলেটি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেখানে উপ¯ি’ত একজন এই অভিভাবককে আশ্বস্ত করে বলেন, “আপা একদম চিন্তা করবেন না। ক্লাস টেনের বা”চাদের কিছুই হয়নি। আমরা ভেতরে গিয়েছিলাম। ক্লাস ফোর আর ক্লাস ফাইভের বা”চারাই মূলত বেশি হতাহত হয়েছে।” ওই অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ছেলের প্রিটেস্ট পরীক্ষা চলছে। ওর কাছে ফোন নেই, এতটা সময় হয়ে গেল কিš‘ ও কোনো খবরও দেয়নি। আমি কোনোরকমে এসেছি। ওর ক্লাস টিচারকে ফোন করেছি তিনি কিছু জানেন না। ওর মিসরাও কোন খবর দিতে পারেননি।” সাদীর মায়ের মত তানিয়া আহমেদ নামের আরো এক অভিভাবক বলেছেন তার মেয়ে রাইসা আহমেদ উ”চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। তার খোঁজ তিনি পা”েছন না।
উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের চিকিৎসা চলছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানকার জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শায়ান, তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানসহ আরো বহু শিক্ষার্থীর। জরুরি বিভাগের বাইরে অপেক্ষায় আছেন এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা। যাদের আহাজারিতে ভারি ওঠে সেখানকার পরিবেশ। ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন “এখন পর্যন্ত ৬০ জনকে জরুরি বিভাগে আনা হয়েছে। দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তাদের অনেকের অব¯’াই আশঙ্কাজনক।” সারা শরীর পুড়ে যাওয়া ১১ বছর বয়সী আরিয়ানের যখন জরুরি বিভাগের ভেতরে চিকিৎসা চলছিল, বাইরে বসে তার মা মনিকা আক্তার আঁখি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আল্লাহ আমার সন্তানরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেও।” “সকাল পৌনে আটটায় স্কুলে গেছে। দেড়টায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল, এরপর দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোচিং। সকালে ছেলেরে খাবার দিয়া দিছি, এরমধ্যে এই ঘটনা ঘটল।” স্কুলের কাছেই তাদের বাসা, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছেলের খোঁজে স্কুলে ছুটে যান বলে জানিয়েছেন আঁখি; এরপর গিয়ে ওই মা ছেলেকে দগ্ধ অব¯’ায় পান। সেখান থেকে তাকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেয়া হয়। ওই হাসপাতাল থেকে আরিয়ানকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। সপ্তম শ্রেণির শায়ানের শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ফুপু রুবিনা আক্তার। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের এই বাসিন্দা বলেন, “সকাল বেলা সু¯’ ছেলেটা বাসা থেকে বের হইল, আর এখন হাসপাতালে।” তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানের মা ঝর্না আক্তারও জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছিলেন। নয়া নগরের এই বাসিন্দা জানিয়েছেন, তার ছেলেকে আইসিউতে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আর একটু পরেই ছুটি হইলে ছেলে বাসায় চলে যেত। আর এখন ছেলে আমার আইসিইউতে।” একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইয়ুম খান বলেন, জুনিয়রদের শিফটটা সকাল থেকে শুরু হয়। “ঘটনার সময় ক্লাসে ছিলাম। তারপর বিকট শব্দ শুনে দেখি আগুন, অব¯’া খারাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তারপর ফায়ার সার্ভিস আসে। “এক আন্টি বলেন বাবা আমার মেয়েকে একটু ধরো, তার দুই হাত পুড়ে গেছে। পরে তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।” উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের প্রশাসন শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, “যাদের কম বার্ন তাদের আমরা এখানে চিকিৎসা দি”িছ। কয়েকজন অভজার্ভেশনে আছে। যাদের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে তাদের বার্ন ইউনিটে রেফার করা হ”েছ। অল্প আঘাত নিয়ে কয়েকজন এসেছিলেন তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।” উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক আকাশ বলেন, “বেশিরভাগের শরীর ৬০-৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের অনেকের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।” হঠাৎ বিপুল সংখ্যক রোগী আসায় এ হাসপাতালে রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে জরুরি ভিত্তিতে ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত খোঁজেন অনেকে মাইলস্টোনের ঘটনায় আহতদের বহনের জন্য মেট্রোরেলে বগি সংরক্ষণ রাখার কথা জানায় পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মেট্রোরেলের নারী বগির পাশের বগি আহতদের বহনের জন্য সংরক্ষণ থাকবে।
রাষ্ট্রীয় শোক: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা এক শোকবার্তায় বলেন, “এই দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারিসহ অন্যান্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ।’’ তিনি বলেন, “সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যব¯’া নেয়ার পাশাপাশি এবং সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে।” প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, মাইলস্টোনের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দেশের সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সকল সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। হতাহতদের জন্য দেশের সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
মাইলস্টোনের যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের খোঁজ পাননি, তাদের জরুরি যোগাযোগের জন্য কয়েকটি ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে। মিলিটারি রেস্কিউ ব্রিগেড ০১৭৬৯-০২৪২০২, সিএমএইচ বার্ন ইউনিট ০১৭৬৯-০১৬০১৯, সিএমএইচ ইমার্জেন্সি ০১৭৬৯-০১৩৩১১, মাইলস্টোন স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ০১৮১৪-৭৭৪১৩২, মাইলস্টোন স্কুলের উপাধ্যক্ষ ০১৭৭১-১১১৭৬৬, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এসব নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে, জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯ পুলিশের জরুরি সেল থেকে বার্ন ইউনিটগুলোর সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেবে। বার্ন ইনস্টিটিউটে হটলাইন; হতাহতের ঘটনায় তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য আলাদা হটলাইন চালু করেছে বার্ন ইনস্টিটিউট। জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের হটলাইন নম্বর হল-০১৯৪৯০৪৩৬৯৭। এই নম্বর ব্যবহার করে সেবা গ্রহণ করা যাবে বলে প্রধান উপদেষ্টার সদর দপ্তর জানিয়েছে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.