হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার: হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, কওমি মাদরাসার সম্মিলিত শিক্ষা সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ ও কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি আল্লামা আহমদ শফী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিলো ১০৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। আল্লামা শফী চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ৩৪ বছর ধরে মুহতামিমের (মহাপরিচালক) দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাদরাসার মজলিসে শূরা কমিটির (পরিচালনা পর্ষদ) সভায় তিনি মুহতামিমের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান। শূরা কমিটি তাকে সদরে মুহতামিম (উপদেষ্টা) নিয়োগ দেয়। পরে মধ্যরাতে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার বিকেলে তাকে ঢাকায় আনা হয়। তার মৃত্যুতে দেশ-বিদেশে আলেম-ওলামা ও কওমি শিক্ষার্থীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুর খবরে আলেম-ওলামা, শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীরা ছুটে আসেন হাসপাতাল চত্বরে। শ্রদ্ধাভাজন এ মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্য আকুতি জানান। কান্নায় ভেঙে পড়েন। এদিকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আহমদ শফীর মৃত্যুর খবর তার প্রিয় কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়। এতে মাদরাসা ও আশপাশের এলাকায় পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। আজ শনিবার বাদ জোহর হাটহাজারীতে প্রিয় ক্যাম্পাস দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। তার অসিয়ত অনুযায়ী মাকবারায়ে জামিয়া মসজিদের পশ্চিম পাশে তার লাশ দাফন করা হবে।

আল্লামা শফীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আরও শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের প্রমুখ।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএম হুমায়ুন কবীর বলেন, বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় আহমদ শফীকে হাসপাতালে আনা হয়। তিনি ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া শুরু করি। সকালে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা উনার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হাসপাতালের মাঠ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা পরিষদের আহ্বায়ক মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, সন্ধ্যার আগে তাকে ঢাকায় আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাগরিবের নামাজের সময় তিনি মারা যান। তিনি বলেন, আল্লামা শফীর মৃত্যুতে দেশবাসী মর্মাহত। এর মাধ্যমে আলেমরা তাদের অভিভাবককে হারালেন। আলেম-ওলামাদের মধ্যে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা কখনই পূরণ হবে না।

আল্লামা শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ার টিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক ও হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ার টিলা কওমি মাদরাসার পরিচালক।

আহমদ শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদরাসায়। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদরাসায় (জিরি মাদাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় যান, সেখানে ৪ বছর লেখাপড়া করেন।

দেওবন্দে থাকাবস্থায় তিনি বহু ইসলামী প-িতের সান্নিধ্যে ইমান-আমলের ওপর মেহনত করেন। তাদের অন্যতম হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা আওলাদে রাসূল মাওলানা সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)। আহমদ শফীর মেধা ও দক্ষতা দেখে ছাত্র অবস্থাতেই তাকে মাওলানা মাদানী (রহ.) খেলাফত প্রদান করেন।

উর্দু, ফার্সি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে সুদক্ষ প-িত আহমদ শফী ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর মাদরাসার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন বিভাগ খোলা ও শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ নেন।

আল্লামা শফী দেশের কওমি মাদাসাগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। যাদের কাছে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি।

আহমদ শফী বাংলায় ১৩টি ও উদুর্তে নয়টি বইয়ের রচয়িতা। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- (বাংলা) ‘হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’, ‘ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা’, ‘ইসলাম ও রাজনীতি’, ‘সত্যের দিকে করুন আহ্বান’ ‘সুন্নাত ও বিদআতের সঠিক পরিচয়’, (উর্দু) ‘ফয়জুল জারি (সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা)’, ‘আল-বায়ানুল ফাসিল বাইয়ানুল হক্ব ওয়াল বাতিল’, ‘ইসলাম ও ছিয়াছাত’, ‘ইজহারে হাকিকাত’।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More