আসাদুল গ্রেফতার : তিতুদহে পাশাপাশি দাফন

সরোজগঞ্জ প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গায় রয়েল এক্সপ্রেসের একটি নৈশকোচের ধাক্কায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ছয়জন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে গতকাল শনিবার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন মিলন হোসেন, শরীফ উদ্দিন, রাজু আহমেদ, সোহাগ আলী, কালু ম-ল ও ষষ্ঠী হালদার। নিহতরা সবাই দিনমজুর এবং আলমসাধু ও পাখিভ্যানের যাত্রী ছিলেন। ঘটনাস্থলেই দুজন ও হাসপাতালে নেয়ার পথে চারজন মারা যান। দুর্ঘটনা কবলিত বাসটিকে আটক করেছে পুলিশ। বাসের চালক আসাদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, চালক ঘুম চোখে গাড়ি চালানোর ফলেই এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিকে, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দিয়ে মালিকপক্ষের আপসের গুঞ্জন উঠলে দুপুরে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করে স্থানীয়রা। পরে পুলিশ গিয়ে সুবিচারের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং অবরোধ তুলে নেয়া হয়।

জানা গেছে, রয়েল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি নৈশকোচ (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-২১৬১) শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার গাবতলী থেকে ছেড়ে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা দেয়। শনিবার সকাল ৬টার দিকে বাসটি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে পৌঁছায়। এ সময় বেপরোয়া গতির বাসটি প্রথমে একটি আলমসাধু, একটি পাখিভ্যান, একটি মোটরসাইকেল ও পরে আরো একটি আলমসাধুকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ভ্যানের দুই যাত্রী ও পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে আরও চারজন মারা যান। নিহতরা হলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খাড়াগোদা গ্রামের পল্লী চিকিৎসক মিলন হোসেন (৪০), তিতুদহ গ্রামের আবদুর রহিম ম-লের ছেলে শরীফ উদ্দিন (৩০), একই গ্রামের পিয়ত আলীর ছেলে রাজু আহমেদ (৪৫), তাহাজ্জত হোসেনের ছেলে সোহাগ আলী (২৫), হায়দার আলীর ছেলে কালু ম-ল (৪০) ও বসু ভা-ারদহ গ্রামের নিতাই হালদারের ছেলে ষষ্ঠী হালদার (৪৫)। নিহতের মধ্যে রাজু, সোহাগ, শরীফ, ষষ্ঠী ও কালু দিনমজুর। পেটের তাগিদে শ্রম বিক্রি করতে সরোজগঞ্জ বাজারে এসেছিলেন তারা। আর পশু চিকিৎসক মিলন হোসেন মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন। তিনি সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে এআই টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

আহতরা হলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ গ্রামের বজলুর রহমানের ছেলে বাবলুর রহমান, তিতুদহ গ্রামের খোদারত ম-লের ছেলে আকাশ আলী, যুগিরহুদা গ্রামের ইকবাল হোসেনের ছেলে নাঈম আহমেদ, বোয়ালিয়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে জিয়া হোসেন, সরোজগঞ্জ গ্রামের আত্তাব আলীর ছেলে সাকিব হোসেন ও সরোজগঞ্জ বাজারের আলমগীর হোসেন। পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। সেখানে গতকাল বিকেলে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার। রয়েল এক্সপ্রেসের চালক আসাদুল আলমকে ঘটনার পাঁচ ঘণ্টার মাথায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত আসাদুল আলম চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ফার্মপাড়ার মৃত আবদুল ওহাবের ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, তখন ভোর ৬টা। রাতের অন্ধকার ভেদ করে কেবল দিনের আলো ছড়াতে শুরু করেছে। কেউবা প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন, কেউ আবার পেটের তাগিদে শ্রম বিক্রি করতে এসেছেন বাজারে। ঘটনাস্থল চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদহ সড়কের সরোজগঞ্জ বাজার। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব হোসেন জানান, দুর্ঘটনার সময় সরোজগঞ্জ বাজারের অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলো বেশ কয়েকটি স্যালোইঞ্জনচালিত যান নসিমন ও আলমসাধু। তার উপরেই বসেছিলেন ১০/১৫ জন দিনমজুর। এমন সময় চট্টগ্রাম থেকে মেহেরপুরগামী রয়েল পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি আলমসাধু ও একটি মোটরসাইকেলের ওপর উঠিয়ে দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুইজন। আহত হন ৯ থেকে ১০ জন। বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী আহত নাঈম আহমেদ বলেন, ‘সকালে আমি দোকানে মুরগি সাজাচ্ছিলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রয়েল পরিবহনের বেপরোয়া গতির বাসটি একের পর এক আলমসাধু, ভ্যান ও মোটরসাইকেল চাপা দিতে থাকে। আমার মনে হয় ওই সময় ড্রাইভারের চোখে ঘুম ছিলো অথবা হেলপার বাস চালাচ্ছিলেন।’ তারা বলেছেন, ৬ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে সরোজগঞ্জ বাজার থেকে মিতালি সিনেমাহল পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত সড়কে তা-ব চালায় বেপরোয়া বাসটি। এর মধ্যে তিনটি যানবাহনের ১৫ জনকে ধাক্কা দেয় রয়েল এক্সপ্রেসের ঘাতক বাসটি।

পাখিভ্যানের যাত্রী বেল্টু রহমান বলেন, তিতুদহ গ্রাম থেকে মোট ৬ জন ধানের পাতু তুলতে সরোজগঞ্জ যুগিরহুদা গ্রামে যাচ্ছিলেন। তাদের সামনে মিলন হোসেন মোটরসাইকেল ও বাকিরা আলমসাধুযোগে যাচ্ছিলেন। তারা সরোজগঞ্জের মিতালি সিনেমাহলের কাছে পৌঁছালে রয়েল এক্সপ্রেস বাসটি পেছন থেকে তাদের একের পর এক ধাক্কা দেয়।

চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম বলেন ‘আমরা সকালে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুজনকে মৃত অবস্থায় পায়। অন্যদেরকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করি। পরে হাসপাতালে নিলে আরও তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তার। এছাড়া রাজশাহী নেয়ার পথে আরও একজন মারা যান।

সকালে দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চুয়াডাঙ্গা থেকে রয়েল পরিবহনগুলো চুয়াডাঙ্গা শহরে থেমে থাকে। নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা দেরিতে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় বাসগুলো। বেলা ১১টার দিকে বাসের চালক আসাদুল আলমকে পুলিশ গ্রেফতার করে জানালেও আসাদুল আলমের পরিবার থেকে জানানো হয়েছে শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিক পক্ষের অনুরোধে রয়েল চালক আসাদুল আলম থানায় আত্মসমর্পণ করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয় ড্রাইভার আসাদুল আলম তাদের জানিয়েছেন, সরোজগঞ্জে বাসটি পৌঁছানোর সময় হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল বাসের সামনে পড়ে। মোটরসাইকেলকে বাঁচাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারালে এ দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

এদিকে, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আহত ও নিহতদের দেখতে যান জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার। এ সময় তিনি নিহতদের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবির জানান, আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদেরকে রাজশাহী ও ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। নিহতদের ময়নাতদন্তের পর স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিতুদহ গ্রামের শরীফ উদ্দিন কালু, রাজু আহমেদ, সোহাগ আলী ও জুম্মা কালুকে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। গ্রামের কবরস্থানে গতকাল সন্ধ্যায় দাফন সম্পন্ন করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খান বলেন, ইতোমধ্যে ঘাতক রয়েল পরিবহনের চালক ও বাসটিকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। এ ঘটনায় তদন্তপূর্বক বাসের চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। গতকাল দুপুরে গুঞ্জন ওঠে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দিয়ে আপস মিমাংসা করার চেষ্টা করছে বাসের মালিকপক্ষ। গুঞ্জনের প্র্রেক্ষিতে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসী। পরে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু জিহাদ মো. ফখরুল আলম খান ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করেন। বাসচালককে গ্রেফতারের খবর জানিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন তিনি। প্রশস্ত সড়কের দু’পাশে থাকা কাঠের গুঁড়ি ও ইট পড়ে থাকায় সড়কটি সরু আকার ধারণ করেছে। এগুলো দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিতে সড়ক অবরোধ তুলে নেয় স্থানীয়রা। এসময় কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মানিক জনতার দাবি দাওয়ার সাথে সহমত পোষণ করেন এবং সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More