২শ ৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এসপিসি’র হোতাসহ ঢাকায় গ্রেফতার ৬

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ দেশ-বিদেশের ২২ লাখ ২৬ হাজার ৬শ ৬৮ জনকে মোবাইলফোন অ্যাপসে সদস্য বানিয়ে প্রতারণা
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা থেকে ঠিক কতোজনের নিকট থেকে কি পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামের অনলাইন ভিত্তিক কোম্পানি? তা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশ ও বিদেশে ২২ লাখ ২৬ হাজার ৬শ ৬৮ জনের নিকট থেকে ২শ ৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পেয়েছে ঢাকার ডিবি। প্রতারণা করে আড়াইশ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া ওই কোম্পানির ঢাকার ৬ জনকে গ্রেফতারও করেছে। চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ ৩ জনকে আটক করলেও তাদের মুচলেকায় মুক্তি দেয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সূত্র বলেছে, চুয়াডাঙ্গার এজেন্টদের বিরুদ্ধে দু’একদিনের মধ্যে মামলা হতে পারে।
ঢাকা মহানগর ডিবি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, অনলাইন ভিত্তিক এসএসপি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের হোতা ও এজেন্টরা প্রথমে এক হাজার ২শ টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফি নিতো। স্থান ভেদে ১ হাজার ৩শ টাকা করেও নিয়েছে। ভালো সুবিধা দেয়া প্রলোভনে ২২ লাখ গ্রাহককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় নিয়ে আসে। পরে প্রতারণার মাধ্যমে ১০ মাসে ২শ ৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। হাতিয়ে নেয়া অর্থ খুঁজে বের করতে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ শুরু করেছে বলেও জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি গাড়ি, একটি পিকআপ, সার্ভারে ব্যবহৃত ৬টি ল্যাপটপ, ২টি রাডার, ২টি পাসপোর্ট ও বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। তাদের আরও কার্যক্রম কীভাবে চলছে, সেটি তদন্তার্থে আমরা খুঁজে বের করবো। কারও অভিযোগের ভিত্তিতে নয় বরং স্ব প্রণোদিত হয়ে গোয়েন্দা পুলিশ এ অভিযান পরিচালনা করেছে জানিয়ে ডিবি বলছে, অবৈধভাবে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গত ২৬ অক্টোবর থেকে সোমবার পর্যন্ত আলামিনসহ চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (ডিবি) অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন টিম। এ ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইনে মামলা করেছে ডিবি।
গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন এফ হক টাওয়ারে কোম্পানিটির অফিসে অভিযান চালিয়ে ম্যানেজার (হিসাব) মো. মানিক মিয়া (৩৪), ম্যানেজার (প্রোডাক্টস) মো. তানভীর আহম্মেদ (৩৫), সহকারী ম্যানেজার (প্রোডাক্টস) পাভেল সরকার (২৮) ও অফিস সহকারী নাদিম মো. ইয়াসির উল্লাহকে (২৮) গ্রেফতার করে ডিবি। তাদের দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সোমবার মোহাম্মদপুর এলাকা হতে মূলহোতা আলামিন প্রধান (৩২) ও মো. জসীমকে (৩২) গ্রেফতার হয়। গ্রেফতার সময় তাদের কাছ থেকে, ১টি হ্যারিয়ার গাড়ি, ২টি পিকআপ ভ্যান, সার্ভারে ব্যবহৃত ৬টি ল্যাপটপ, ২টি রাউটার, ২টি পাসপোর্ট ও বিভিন্ন কাগজপত্র জব্দ করা হয়।
জানা গেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া বহুল আলোচিত এমলএম কোম্পানি ডেসটিনির আদলে গ্রাহক সংগ্রহ করে, ইউনিপে টুর মতো মোটা অঙ্কের লাভের লোভ দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতে ফাঁদ পাতে আল আমিন প্রধান ও তার সহযোগীরা। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ডেসটিনির ব্যবসাকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এ পথ বেছে নেয় তারা। সফলও হয় এই চক্র। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ২২ লাখ ২৬ হাজার ৬৬৮ জন গ্রাহকের কাছ থেকে পিরামিড আকৃতির এ ব্যবসার মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ই-কমার্সের নামে লাইসেন্স নিয়ে মাত্র ৮ মাসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের নামে অনলাইন ভিত্তিক কোম্পানি খুলে তারা। পুলিশ আরও বলেছে, এস.পি.সি. ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডে নামে কোম্পানি ই-কমার্সের আড়ালে লাইসেন্স বিহীন পিরামিড আকৃতির অনলাইনভিত্তিক মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পরিচালনা করে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া ২৬৮ কোটি টাকার হদিস করা হচ্ছে। উদ্ধার করার চেষ্টার পাাশাপাশি এদের সাথে আরও যারা জড়িত তাদেরও খোঁজা হচ্ছে।
ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, তারা মূলত কোম্পানির ওয়েব সাইট, ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউবে শত শত পোস্টের মাধ্যমে ই কমার্সের কথা বলে সাধারণ জনগণকে লোভনীয় কমিশনের লোভ দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতো। পরে আগ্রহীদের প্লে-স্টোর বা এস.পি.সি. ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের ওয়েবসাইট থেকে একটি মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করে এর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হতো। রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাধ্যতামূলক পূর্ববর্তী রেজিস্ট্রিকৃত আপলিঙ্ক আইডির রেফারেন্সে কোম্পানির দেয়া বিকাশ, নগদ, রকেট নম্বরে প্রতিটি আইডির জন্য ১২০০ টাকা পরিশোধ করতে বলা হতো। কোম্পানিটি বিভিন্ন ধরনের কমিশন যেমন (রেফার কমিশন, জেনারেশন কমিশন, রয়্যাল কমিশন) এর ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করতো সদস্যদের সাথে। চুয়াডাঙ্গায় কয়েকজন ব্যক্তি ওই কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাতারাতি। গত শুক্রবার রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের শেখপাড়ার একটি বাড়ি থেকে তিনজনকে সদর থানা পুলিশ আটক করে। আটকের পরদিন মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এদের বিরুদ্ধে কেউ বাদি না হওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে থানা পুলিশের তরফে বলা হয়। চুয়াডাঙ্গায় যাদেরকে আটক করা হয় তারা হলেন আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ি টাকপাড়ার রেজাউল হকের ছেলে আলামিন, পাঁচকমলাপুরের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে জীবন ও মেহেরপুর রঘুনাথপুরের লাল্টু মিয়ার ছেলে ইসলাম মিয়া। এরাও রাতারাতি অনেক টাকার মালিক বনে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে আলামিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার ও বন্ধু জসীমের নামে এস.পি.সি. ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডে নামে একটি ই-কমার্স কোম্পানির লাইসেন্স নেন। এরপর শুরু করেন অবৈধ এমএলএম ব্যবসা। ফেসবুক, ইউটিউবে চকটদার বিজ্ঞাপন দিতো তারা। একসময় চরম আর্থিক সংকটে থাকলেও প্রতারণার মাধ্যমে তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। আলামিন এ কোম্পানিটির অনলাইন হোস্টিং এর জন্য শুধু আমাজনকেই প্রতি মাসে ৭০০০ ডলার পরিশোধ করতো। অবৈধভাবে উপার্জিত টাকায় আলামিন সাভার ও নারায়ণগঞ্জে জমি কিনেছে, এছাড়া তার ৮টি ব্যাংক হিসাবে অন্তত ১২ কোটি টাকা থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. নাজমুল হক দেশ রূপান্তরকে জানান, চক্রের হোতা আলামিন অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তার ব্যবহৃত মোবাইলফোনটি বেশির ভাগ সময় বন্ধ করে রাখতো। চক্রটি অল্প দিনে প্রতারণার মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে। বিদেশেও তাদের ৫ লাখ সদস্য রয়েছে। অন্তত ৭০টি দেশে তাদের কার্যক্রম চলমান ছিলো বলে আলামিন স্বীকার করেছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত ১৭টি দেশের তথ্য পেয়েছি। তাদের অন্যান্য সহযোগীকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। এ ধরনের আরও কিছু কোম্পানির তথ্য রয়েছে আমাদের হাতে। তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত অভিযান চালানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমএলএম ব্যবসা আড়াল করার কৌশল হিসেবে কোম্পানিটি নামে মাত্র কয়েকটি পণ্য (অ্যালোভেরা শ্যাম্পু, ফেইসওয়াশ, চাল, ডাল, মরিচের গুঁড়া ইত্যাদি) শুধুমাত্র তাদের রেজিস্টার্ড মেম্বারদের কাছে বিক্রি করতো। বিক্রিত লভ্যাংশ থেকে প্রতি আইডি হোল্ডারকে কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখার বিনিময়ে ১০ টাকা করে প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হতো। তবে ৫০ দিন দেখার পর ৫০০ টাকা করে পেতো তারা। গ্রেফতারকৃতরা ই-কমার্সের লাইসেন্স দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করায় যে তারা ই-কমার্স করছে। পিরামিড আকৃতির রেফার কমিশন সম্পর্কে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মীর মোদাছ্ছের হোসেন বলেন, যে রেফার করবে সে তার নিচের ৩টি আইডি থেকে ৪০০ টাকা করে কমিশন লাভ করবে। তারপর ওই ৩ আইডি থেকে যখন ৯টি আইডি হবে তখন আপলিংকের আইডি ২০ শতাংশ কমিশন পাবে। তারপর তার ডাউনলিংকে যতো আইডি হবে আপার আইডি ১০ শতাংশ হারে কমিশন পাবে। যা মূলত পিরামিড আকৃতির হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যবসা বাংলাদেশের আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More