দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে শ্রমবিক্রি করছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৬০ ছাত্র

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এক জমিতে ধান কাটছে আট যুবক। এরা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া যুবক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স’র ছাত্র সোহেল রানা ধানের আটি বাঁধতে জানে না, তাই ধান কাটছে। টিটন মিয়া কাটা ধানের আটি বাঁধতে ব্যস্ত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পড়েন। চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন মিঠুন রহমান, শাহান আতিক ও রকছিদুল ইসলাম। তারাও ধান কাটছেন। পূর্বে ধান কাটার অভিজ্ঞতা না থাকলেও গত ১০ দিনের অভিজ্ঞতায় এখন মোটামুটি দক্ষ তারা। বিএসসি পড়ুয়া রিন্টু মিয়াসহ আরও দুই যুবক ধানের আঁটি মাথায় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন গেরস্তের খোলায়। উপরের ওই দৃশ্য চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ভোলারদাইড় গ্রামের। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এ গ্রামের ৬০জন যুবক করোনা সঙ্কটকালে নিজেরা শ্রম বিক্রি করে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তারা অন্যের পানক্ষেত, কলাক্ষেত, ভুট্টা ও ধান ক্ষেতে শ্রম বিক্রি করে যে উপার্জন করেন, তাই দিয়ে নিজ গ্রামসহ পাশের নাগদাহ ও বেনাগাড়ি এ তিন গ্রামের দরিদ্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বজনের মতো। সারাদেশে যুবসমাজের কাছে হয়ে উঠেছেন উদাহরণ। ক্যাম্পাস বন্ধ এ সুযোগে গ্রামে ফিরে কৃষি কাজে শ্রম দিচ্ছেন তারা। শ্রমের উপার্জিত টাকা দিয়ে গত প্রায় ১ মাস ধরে গরিব-দুঃখির মাঝে দু’বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন। তারা অনেকে করোনা ছুটিতে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরেছেন। এ মহৎ উদ্যোগের শুরুর কাহিনী বলতে গিয়ে মিঠুন রহমান জানান, করোনা প্রথম ধরা পড়ার পর অর্থাৎ ৮ মার্চের পর ৮-১০ জন বন্ধু গ্রামে জীবানুনাশক স্প্রে করতাম, হ্যান্ড স্যানেটাইজার ব্যবহারে উৎসাহিত করতাম। এমনকি সেই সময়েই গ্রাম লকডাউন করি। কিন্তু শুধু এই কাজগুলোই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যতেষ্ঠ মনে হয়নি। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কষ্ট যারপরনাই ভাবিয়ে তোলে। এক সন্ধ্যায় কয়েক বন্ধু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তারা কলেজপড়ুয়া গ্রামের সকল যুবকদের ডেকে একত্রিত করি। সকলে একমত হই কিছু একটা করতে হবে। এই ভাবনা থেকে ৬০ জন শিক্ষিত যুবক নিয়ে গঠন করা হলো ভোলারদাইড় যুব সংঘ। সিদ্ধান্ত নিলাম ৬০জন শ্রম বিক্রিলব্ধ টাকা নিয়ে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াবো। সোহেল রানা জানান, অবশ্য প্রতিদিন ৬০ জন শ্রম দেয় না। গড়ে প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন করে শ্রম দেন। ভোরে সেহরি খেয়ে নামাজ শেষে গ্রামের সহর আলীর দোকানের সামনে উপস্থিত হতে হয়। সোহেল রানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মাহিন বলা শুরু করেন। বলেন, সব কাজ তো সকলে পারেন না, তাই উপস্থিত যুবকদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে কোনো গ্রুপ ভুট্টা ক্ষেতে, কোনো গ্রুপ পানবরজে আবার কোনো গ্রুপ যায় ধান কাটতে। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পালাক্রমে শ্রমবিক্রি চলছে। রিমন জানান, তারা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেদের উপার্জিত টাকায় চাল, আটা, ডাল, তেল, আলু, পেয়াজ ও সাবান পৌঁছে দেন। শুধু নিজেদের গ্রাম না, এখন পার্শ্ববর্তী আরও ২ গ্রামের দরিদ্রদের একই সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আপনাদের দেখে অন্য যুবকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে শোভন জানান, তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে পার্শ্ববর্তী পাইকপাড়া গ্রামের কয়েকজন যুবক নিজ গ্রামে অনুরূপ কর্মকা- শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাহান আতিক জানান, পরিস্থিতি যতদিন স্বাভাবিক না হয় যেকোনো কাজ করে সহায়তাটা অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু এলাকায় ভুট্টা ক্ষেত, পানবরজের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। আগামী ৭ সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটা ও মাড়ায়ের কাজও শেষ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে এ কর্মকা- চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। সংশ্লিষ্ট নাগদাহ ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ছাত্র সমাজের এমন ভালো কাজ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দেবে। যুব সমাজ যে এখনও ফুরিয়ে যায়নি, তারা যে সমাজ পরিবর্তনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে তার উদাহরণ দেখিয়ে দিয়েছেন তারা। আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী বলেন, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এ যুবকরা দেশপ্রেম ও আর্ত মানবতার সেবায় সারাদেশে উদাহরন সৃষ্টি করেছেন। দেশের প্রতিটি সঙ্কটে তাদের কর্মকা- উদাহরণ হয়ে জাতিকে সাহস জাগাবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More