নারীর মৃত্যুনিবন্ধন : প্রক্রিয়া সহজ ও সাশ্রয়ী হোক

স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে যারা দেশ শাসন করেছেন, তারা কেউ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখাননি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরও অনেক কমিশনের সঙ্গে নারী অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে, যার প্রতিবেদন অনেক আগেই পেশ করা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, একটি মহলের হুমকির মুখে সরকার এ কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি। এটা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় সমস্যাই বটে। আমাদের সমাজে নারীরা সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির তথ্য (নাম, বয়স, মৃত্যুস্থান, তারিখ) মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আইনটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটা ফর হেলথ ইনিশিয়েটিভের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, পুরুষের মৃত্যুনিবন্ধন হচ্ছে ২৬ শতাংশ, নারীর ৫ শতাংশ। গবেষণায় নারীর মৃত্যুসনদ কম হওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচটি বাধার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে নিবন্ধন বিষয়ে মানুষের অসচেতনতা, নারীর সম্পদ না থাকায় পরিবারের সদস্যদের অনাগ্রহ, আইনি জটিলতায় না পড়া পর্যন্ত নিবন্ধন না করা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব, সরকারি দপ্তরগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা। নারীর মৃত্যুসনদে নারীর পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ সম্পত্তিতে তার অধিকার না থাকা। বাংলাদেশে জমি ও অন্যান্য সম্পদের মালিক প্রধানত পুরুষ। শহরে নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি। শহরে বসবাসকারী নারীদের অনেকেই বাড়ি–ফ্ল্যাট জমির মালিকানা আছে। আবার কর্মজীবী হিসেবে তাঁদের ব্যাংক হিসাবও রাখতে হয়। ফলে তাদের উত্তরাধিকারীর বিষয়টি সামনে আসে আর মৃত্যুনিবন্ধন ছাড়া তা বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ সম্পদের মালিকানা পুরুষের। উত্তরাধিকারসূত্রে নারী কোনো সম্পদের মালিক হলে পুরুষ আত্মীয়স্বজন তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়ার বহু নাজির আছে। এ ক্ষেত্রে তারা নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের বিষয়ে আগ্রহ দেখান না। ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ও পরিচালক লরা রিচেনবেচ যথার্থই বলেছেন, নারীর মৃত্যুনিবন্ধন শুধু পরিসংখ্যানগত বিষয় নয়, এটি অধিকারের বিষয়। আমরা যত দিন সর্ব ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে না পারব, ততো দিন মৃত্যুনিবন্ধনের সমস্যাটি থেকেই যাবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দায় আছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও। গবেষণায় আরও যেসব বাধার কথা বলা হয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগ সক্রিয় হলে সহজেই সমাধান করা যায়। নিবন্ধন দুভাবে নিশ্চিত করা যায়। প্রথমত, মৃতের আত্মীয়স্বজন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্যটি পৌঁছে দেবে। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট দপ্তর নিজে থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। বাস্তবে দেখা গেছে, অফিস বাড়ির কাছাকাছি হলে বা নিবন্ধন কার্যালয়ের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সম্পর্ক ভালো থাকলে মৃত্যুনিবন্ধন হয়। গবেষকেরা রংপুর বিভাগের দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলায় চারটি উপজেলা নিয়ে এই গবেষণা করলেও সারা দেশের চিত্রও কমবেশি একই রকম। একটি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিতেও জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনটি জরুরি। ফলে এটিকে কেবল সংখ্যা হিসেবে দেখলে চলবে না, এ বিষয়ে যেমন সচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ ও সাশ্রয়ী করতে হবে। ভবিষ্যতে নারী-পুরুষনির্বিশেষ প্রত্যেক নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More