অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্রীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কটি কমিশন করেছিলো, তখন জনমনে যে আশা জেগেছিল, তা অনেকটা মøান হয়ে গেছে বলে ধারণা করি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম দফার বৈঠক দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় ক্ষমতার ভারসাম্যসহ মৌলিক প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে (জুনের প্রথম সপ্তাহ) দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হতে পারে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা হবে। জুলাই সনদের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছে। দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যেতে যে সংস্কারের প্রয়োজন আছে, সেটা সব রাজনৈতিক দলই স্বীকার করেছে। কিন্তু সেই সংস্কারের ধরন ও মাত্রা নিয়ে মতভেদ আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, এক ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আবার একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হওয়ায় সংসদও তার আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেয়া দূরের কথা, কথা বলারও সুযোগ নেই। গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে এ বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনা জরুরি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সব দল একমত থাকলেও নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধ আছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায় নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন নির্ধারিত হোক। এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দল বলেছে, এটি হতে হবে নিম্নকক্ষের ভোটের হারের ভিত্তিতে। অন্যান্য দল এক ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার পক্ষে থাকলেও বিএনপি তা মানতে নারাজ। অন্যদিকে বিএনপির ও সহযোগী দলগুলোর মতে, এই সরকার সব সংস্কার করতে পারবে না। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং স্বৈরাচারী শাসনের পুনরাগমন ঠেকাতে যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটাই তাদের করা উচিত। এর বাইরে গেলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে; ইতিমধ্যে যার আলামত শুরু হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো দল সংস্কার ও বিচার শেষ করে নির্বাচন করার পক্ষপাতী। এ অবস্থায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি সহজ নয়। তবে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারকে সেই দুরূহ দায়িত্ব থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে সংস্কারের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সংস্কারের নামে নির্বাচন অহেতুক বিলম্ব করা যাবে না। ইতিমধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বাড়ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে, তা আলোচনা করে দ্রুত জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জুলাই বা জাতীয় সনদ নির্বাচনের বিষয়ে এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি, যার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনের পথনকশা তৈরি হবে। তার সঙ্গে আমরাও আশাবাদী হতে চাই, দ্বিতীয় দফা আলোচনায় নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে এবং সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.