অফিসে হাজতির সঙ্গে সুন্দরী নারীর ৪৫ মিনিট

স্টাফ রিপোর্টার: হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম আসামি তুষার আহমেদের সঙ্গে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক নারীর দীর্ঘ সাক্ষাতের বিষয়টি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে হয়েছে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর জেলার নুর মোহাম্মদ, ডেপুটি জেলার মো. গোলাম সাকলাইন, ডেপুটি জেলার তানিয়া ফারজানাসহ কয়েকজন কারারক্ষীকে বন্দি তুষার মোট ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। অনৈতিক কাজের জন্য এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা জানাজানির পর জেল সুপার রতœা রায় কারা মহাপরিদর্শকের কাছে এভাবেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে এই প্রতিবেদনে নিজেকে আড়াল করার সব চেষ্টাই করেছেন তিনি। বাস্তবতা হচ্ছে-ঘটনার দিন ৬ জানুয়ারি মহিলাসহ তিনজন প্রবেশের ১৯ মিনিট পর জেল সুপার রত্মা রায় কারা অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন শনিবার বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে জেল সুপারের প্রতিবেদন পেয়েছি। এখন নিয়মানুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি কমিটি হয়েছে। একটি জেলা প্রশাসন থেকে, অপরটি কারা অধিদফতর থেকে। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. আবরার হোসেনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি ওই মহিলা নাকি হাজতির স্ত্রী। সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের কী আছে। তবে যেভাবে সাক্ষাৎ করার বিষয়টি সিসিটিভি ফুটেজে এসেছে, তা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত।’ তিনি বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্টে যারা দায়ী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ঘটনার সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে গিয়ে জেল সুপারের কাছে টাকা লেনদেনের বিষয়টি উঠে আসে। ১২ জানুয়ারি আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা জেল সুপারের সঙ্গে দেখা করেন। এসময় তারা জানান, অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহযোগিতা করে জেলার নুর মোহাম্মদ ১ লাখ, ডেপুটি জেলার ২৫ হাজার এবং অন্যান্য সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর, গেট সহকারী প্রধান কারারক্ষী ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন। এই ঘটনা সম্পর্কেও তিনি কিছুই জানেন না।
জানা যায়, কারাগার অনুসরণে রাখেন এমন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে জেল সুপার রতœা রায় জানতে পারেন, একজন সাধারণ বন্দির সঙ্গে অফিস কক্ষে তিনজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। এদের মধ্যে একজন মহিলা। বন্দি তুষার ওই মহিলাকে সঙ্গে নিয়েই ৬ জানুয়ারি কারা অফিসের একটি রুমে দীর্ঘ সময় কাটান। কারাভ্যন্তরের দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার পর জেল সুপার নিশ্চিত হন বিষয়টির সঙ্গে জেলার নুর মোহাম্মদ মৃধা জড়িত। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সামনে জেলার নুর মোহাম্মদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সব অস্বীকার করেন।
কারা সূত্র জানায়, মহিলাসহ তিনজন কারাগারের অফিস কক্ষে প্রবেশ করেন ৬ জানুয়ারি ১টা ৫৬ মিনিটে। কারা সেল থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা তুষার কারা অফিসকক্ষে আসেন ২টা ৪ মিনিটে। এরপর জেল সুপার রতœা রায় অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে যান ২টা ১৫ মিনিটে। কারা অফিসের একটি কক্ষে টানা ৪৫ মিনিট অবস্থান করেন তুষার ও ওই সুন্দরী নারী।
এদিকে প্রতিবেদনে জেল সুপার উল্লেখ করেন, বর্তমানে নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারিভাবে সব শ্রেণির বন্দিদের জন্য পারিবারিক সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা জেলারের অনুমতি সাপেক্ষে কারাগারের অফিসে প্রবেশ করে থাকেন। কাজেই জেলারের অথবা কর্তব্যরত ডেপুটি জেলার অথবা গেট কারারক্ষীর অবহিতকরণ ছাড়া কেউ অফিসে প্রবেশ করছেন, তা কোনো সুপারের পক্ষে জানা সম্ভব না। অধিকন্তু শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিশেষ শ্রেণির বন্দির অফিসে সাক্ষাতের জন্য দরখাস্তের মাধ্যমে সুপারের অনুমোদন সাপেক্ষে অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সাক্ষাতের বিষয়ে জেল সুপারের জানার বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই। করোনাকালীন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের বাহির গেট (আরপি গেট) দিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কারোরই প্রবেশের সুযোগ নেই। সামগ্রিক বিষয়টি ওয়াকিটকির মাধ্যমে না বলে গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হওয়ায় জেল সুপার জানতে পারেননি।
প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়, হাজতি বন্দি তুষার আহমেদ একজন সাধারণ বন্দি। তিনি শ্রেণিপ্রাপ্ত নন। এ কারণে তার অফিসে এসে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি জেলারসহ সংশ্লিষ্টরা অবগত আছেন। ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও গেট ওয়ার্ডার সহকারী প্রধান খলিলুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তারা জেলারকে অবগত করে বন্দি তুষারকে অফিসে নিয়েছেন। তৎসম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন মধ্যাহ্নকালীন ডিউটি অফিসার ডেপুটি জেলার তানিয়া ফারজানা, গেট ওয়ার্ডারও জেল সুপারকে কিছুই জানাননি। ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন নিজে কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে হাজতি বন্দি তুষারকে অফিসে নিয়ে আসেন। এ সময় কয়েদি বন্দি আ. রউফ মিয়া সাকলাইনের সঙ্গে ছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড থেকে এসব তথ্যচিত্র ধরা পড়ে।
সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে জেল সুপার প্রতিবেদনে বলেন, হাজতি বন্দি তুষার এবং ওই মহিলা জেলারের রুমের দিকে যায়। ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, বন্দি তুষার এবং ওই মহিলার সাক্ষাতের বিষয়টি জেলার জানেন।
এদিকে জেল সুপারের প্রতিবেদনে কয়েদি বেঞ্চে বসে তুষার ও ওই মহিলার সাক্ষাতের কথা বলা হয়। অন্যদিকে ডেপুটি জেলার তানিয়া ফারজানা তার জবানবন্দিতে বলেন, ওইদিন দুপুর পৌনে ১টার দিকে তিনি বাসায় যান। পৌনে ৩টার দিকে অফিসে প্রবেশ করে দেখতে পান ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইনের অফিস কক্ষে সাক্ষাৎ চলছে। এ বিষয়ে একজন কারা কর্মকর্তা জানান, প্রকৃত চিত্র এখানে গোপন করা হয়েছে। জেল সুপার রতœা রায় নিজেকে আড়াল করতে পারেন না।
তিনি বলেন, একটি কারাগারের প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা জেল সুপার। তিনি যদি একটি ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে চান, তা তিনি পারবেন। তবে প্রকৃত ঘটনা বের করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে অধীনস্থ ছোট পদের কর্মচারী বা কারারক্ষীরা সত্য বলতে চাইবে না। বিষয়টি কারা অধিদফতরের আমলে নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে জেল সুপার রতœা রায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। ব্যক্তিগত ও দাফতরিক দুটি নম্বরে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে এ বিষয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More