রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার দিয়ে শুরু : দু’দিন আগে লকডাউন এলাকার নাম ঘোষণার দাবি

লাল হলুদ সবুজে নেই সমন্বয় : জোনভিত্তিক লকডাউন প্রস্তাব অনুমোদন
স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জোনভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আজ মধ্যরাত থেকে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার এলাকা লকডাউনের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন হিসেবে আখ্যায়িত করে অবরুদ্ধ করা হবে।
তবে এই লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিতের মাধ্যমে লকডাউন করা নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর আগে সাধারণ ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়েই কার্যত লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এবার প্রথম থেকেই এটা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। আজ মধ্যরাতে রাজাবাজার দিয়ে শুরু হলেও পরে কোন এলাকা রেড, ইয়েলো বা গ্রিন জোন চিহ্নিত করা হয়েছে, তা কেউ প্রকাশ করছেন না। কবে কোন এলাকা অবরুদ্ধ করা হবে, তা বলা হচ্ছে না। এর আগে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন জোনভিত্তিক লকডাউনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। অথচ অন্যান্য সংস্থা থেকে এলাকা নির্ধারণ করে বলা হয়েছে- রোববার থেকে লকডাউন শুরু হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে গত রোববার ঢাকায় এ সংক্রান্ত কিছুই হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে জোন চিহ্নিত করে তালিকা দেয়া হয়। পরে বলা হয় ওই তালিকা পুরনো। কিন্তু নতুন তালিকা ঘোষণার বিষয়ে কিছুই বলছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতিতে মানুষের দাবি- কোনো এলাকা অবরুদ্ধ করা হলে কমপক্ষে দু’দিন আগে যেন ঘোষণা দেয়া হয়। এতে তারা বাজারসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলো গুছিয়ে নিতে পারবেন।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটা কেবিনেট মিটিংয়ে আলোচনা হয়নি, মন্ত্রী (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) মহোদয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। আমাদের যে সংক্রামক ব্যাধি আইন আছে, এটা সেই আইনের মধ্যে দেয়া আছে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর অথরাইজড। খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন যে, আইটি ব্যবহার করে যেভাবে জোনিং করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে এটা সারা পৃথিবীতে করা হচ্ছে। এটায় সুবিধা আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য এক্সিকিউটিভ মিনিস্ট্রি তারা বসেই যদি মনে করে কোনো জায়গাকে রেড জোন ডিক্লেয়ার করতে হবে, তা করা সবার জন্যই ভালো। কারণ, সবাই তখন সতর্ক হতে পারবে। কোনো এলাকায় যদি অধিক সংক্রমণ থাকে, সেই এলাকাকে যদি স্পেশালি নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়, সে বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন গতকালই।’ তবে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন এলাকার বিষয়ে বা কবে থেকে লকডাউন কার্যকর হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা আজ রাত ১২টার পর থেকে লকডাউন করা হবে। সোমবার মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলার লক্ষ্যে ডিএনসিসি এলাকার জন্য গঠিত কমিটির এক অনলাইন সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এর মাধ্যমেই শুরু হতে যাচ্ছে এলাকাভিত্তিক লকডাউন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হারের ওপর ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমে রাজধানীসহ দেশের সংক্রমিত এলাকা তিনটি জোনে ভাগ করে লকডাউন শুরু হবে।
এর আগে গত ১ জুন সচিবালয়ে তিন মন্ত্রী এবং ঢাকার দুই সিটি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চার মেয়র বিশেষ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে জোনভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সারা দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি এবং স্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর জোনভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়। এই লকডাউন বাস্তবায়নে কারা কাজ করবেন, কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে তৈরি করা হয় চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা। এটি রোববার অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
এদিকে গত শনিবার (৬ জুন) রাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের লকডাউন এলাকার তালিকা। ‘গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোন’-এই তিন ভাগে ভাগ করে তালিকা প্রকাশ করা হয়। জোনভিত্তিক মানচিত্র প্রকাশের পর থেকেই দেশব্যাপী বিভিন্ন এলাকায় অস্থিরতা দেখা দেয়। ওই ম্যাপ দেখে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে যোগাযোগ শুরু করে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তোলপাড়। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেয়। কেউই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেন নাই।
কর্মপরিকল্পনায় যা আছে : করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে জোনভিত্তিক লকডাউন কীভাবে কার্যকর হবে-এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর একটি হল সিটি কর্পোরেশনের উপযোগী। আর অন্যটি সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকার জন্য। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন অফিস, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সম্পৃক্ততার সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রেড জোনে দিনের বেলা কোনো পরিবহন চলাচল করবে না। তবে রাতের বেলা মালামাল পরিবহন করা যাবে। শপিং মল বন্ধ থাকলেও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকবে। ইয়েলো জোনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলতে পারবে। রিকশায় চলতে হবে একজন করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা রাখা যাবে। রেস্তোরাঁ খোলা থাকলেও সেখানে ভিড় না জমিয়ে খাবার কিনে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। গ্রিন জোনে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে হবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, রেড জোনে শুধু ফার্মেসি, হাসপাতাল, নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে। কাঁচাবাজার, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, শপিং মলসহ সব ধরণের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টিনে রাখাও নিশ্চিত করা হবে। রেড জোনে জনসমাগম রুখতে কাঁচাবাজার বন্ধ রেখে ভ্রাম্যমাণ ভ্যান ও মাথায় ঢুলি নিয়ে চলা ফেরিওয়ালাদের পণ্য বিক্রি করতে দেয়া হবে। ১৪-২১ দিনের জন্য লকডাউন করা হবে। লকডাউন নিশ্চিত হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করবে পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক মনিটরিং কমিটি। রেড জোনে থাকা কেউ যাতে ওই এলাকার বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের লোকজন যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে তার জন্য সংশ্লিষ্ট পয়েন্টগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেবে। বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের করোনা উপসর্গ দেখা দেবে, তাদের নমুনা সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হবে। রোগী বেশি হলে একাধিক বুথ স্থাপন করা হবে। নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র বা পাশে থাকা আবাসিক হোটেলে টেকনোলজিস্টদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় কোয়ারেন্টিনে থাকার পর টেকনোলজিস্টদের রেড জোন থেকে বের হতে হবে।
ইয়েলো জোনে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পাওয়া যাবে। এখানে পুরো এলাকা লকডাউন না করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। তবে নির্ধারিত নিয়মকানুন কড়াভাবে পালন করতে হবে বাসিন্দাদের। যেমন একসঙ্গে দু-তিনজনের বেশি হাঁটা যাবে না। বাসার বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যে কোনো ধরনের জনসমাগম রোধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বা ওয়ার্ড কমিটি পর্যায়ক্রমে টহল দেবে। কোনো বিষয় তাদের আয়ত্তের বাইরে থাকলে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করবে। প্রয়োজনীয় জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এখানে ফার্মেসি, হাসপাতাল ও কাঁচাবাজার খোলা থাকলেও অন্য সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কুইক রেসপন্স টিমের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর বাড়ি লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া গ্রিন জোনেও কিছু বিষয়ে কঠোরতা বজায় রাখা হবে, যাতে করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী এই এলাকায় ঢুকতে না পারে, তা নিশ্চিতের চেষ্টা করা হবে। গ্রিন জোনের কেউ আক্রান্ত হলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হবে। যাতে এই এলাকার কেউ আক্রান্ত না হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে শনিবার দেশের তিনটি বিভাগ, ৫০টি জেলা ও ৪০০টি উপজেলাকে পুরোপুরি লকডাউন (রেড জোন বিবেচিত) দেখানো হয়। আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) দেখানো হয়েছে দেশের ৫টি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) এমন জেলা দেখানো হচ্ছে একটি এবং উপজেলা দেখানো হয় ৭৫টি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More