সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: টানা ৪০ দিনের লড়াইয়ের পর দীপাবলির দুপুরে একরাশ বিষণœতা ছড়িয়ে চলে গেলেন বাঙালির ভালোবাসার চরিত্র ‘অপু’ ও ‘ফেলুদা’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। করোনাকে হার মানালেও জীবনের ৮৫টি বসন্ত পেরিয়ে বার্ধক্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা, আবৃত্তিকার, মঞ্চাভিনেতা ও পত্রিকা সম্পাদক। রোববার ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে তার প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়লে শুধু দুই বাংলা নয়, বিশ্বের সব বাঙালি সমাজে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়াতের পরিবারকে শোকবার্তা পাঠিয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় তিনি বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তার সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। এছাড়া শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ওদিকে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, অমিতাভ বচ্চন, অর্পনা সেন, শর্মিলা ঠাকুর, ববিতা, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ গাঙ্গুলী প্রমুখ।
বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্রের ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলাদেশের ববিতা। সেই ছবির স্মৃতিচারণ করে ববিতা বলেন, ছবির প্রথম শট সৌমিত্র দাদার সঙ্গে ছিলো। আমি খুব ভয়ে ছিলাম, তার মতো জাঁদরেল শিল্পীর সঙ্গে কাজ করছি। সৌমিত্র দাদা প্রচ- ভালো মানুষ ছিলেন। খুব আপন করে নিয়েছিলেন। সেটে তিনি সহযোগিতা করতেন। পরামর্শ দিতেন। অত নবীন হওয়ার পরও আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছেন। শুটিংয়ের অবসরে কাগজে গেম খেলতাম তার সঙ্গে। অবসরে আবৃত্তি করে শোনাতেন।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ৬ অক্টোবর কোলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন এ প্রবীণ অভিনেতা। প্লাজমা থেরাপির পর তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। প্রথমে চিকিৎসায়ও সাড়া দিতে থাকেন তিনি। একসময় তার গান ও আবৃত্তি চালিয়ে মিউজিক থেরাপিও শুরু হয়। গত বুধবার বর্ষীয়ানের ট্র্যাকিওস্টমি অপারেশন করা হয়। বৃহস্পতিবারই ফের প্লাজমাফেরেসিস হয়। ডাক্তাররা ভেবেছিলেন, প্লাজমাফেরেসিসের পর তার আচ্ছন্নভাব ও অসংলগ্নতা কেটে যাবে। কিন্তু শুক্রবার তার কিছুই হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডা. অরিন্দম কর জানান, সৌমিত্রের শারীরিক অবস্থার অবনতির মূল কারণ কোভিড এনসেফ্যালোপ্যাথি। রোববার সকালে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে। কোনো ওষুধেই আর সাড়া দিচ্ছিলেন না তিনি। কমছিল রক্তচাপ এবং রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা।
সৌমিত্রের প্রয়াণে শুধু কোলকাতার টলিউড নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতেও গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কারণ বাংলাদেশের প্রবীণ অভিনেত্রী ববিতা থেকে শুরু করে অনেকেই তার সঙ্গে নানা ছবিতে অভিনয় করেছেন। ঢাকার নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ছিলো তার গভীর সম্পর্ক। বাঙালির আরেক মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলেছেন স্বকীয়তার ওপর ভিত্তি করে। এ কারণে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘দাদা সাহেব ফালকে’ থেকে শুরু করে ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন দ্য নর’ সম্মান পেয়েছেন। এদিন দুপুরে মৃত্যুর পর তাকে প্রথমে যাদবপুরের গলফ গ্রিনে নিজের বাড়িতে, পরে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রঞ্জিত মল্লিক, আবীর চট্টোপাধ্যায়, জিৎসহ টলিউডের নবীন, প্রবীণ শিল্পীরা শ্রদ্ধা জানান। এরপর রবীন্দ্রসদনে শিল্পী থেকে মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকরা শ্রদ্ধা জানান। এরপর সন্ধ্যায় শোকযাত্রা করে কেওড়াতলা শ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গানস্যালুটে শেষবিদায় জানানো হয় কিংবদন্তি অভিনেতাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ওই শেষযাত্রায় অংশ নেন। শ্রদ্ধা জানান বিজেপি সংসদ সদস্য অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলী ও বামপন্থী নেতাকর্মীরা।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের কয়া গ্রামে আদিবাড়ি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের। তার প্রপিতামহ প্রথম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে (বর্তমানে সূর্য সেন স্ট্রিট) জন্ম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ছোটবেলার বেশ কিছুটা কেটেছে কৃষ্ণনগরে। সেখানেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাড়িতে নাটকের চল ছিল। তাই ছোট্ট সৌমিত্রের নাটকের প্রতি টান। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। ততোদিনে শিশির ভাদুড়ির অভিনয়ের অনুরাগী হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ রায় যখন ‘অপরাজিত’র জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। তখনই তার সঙ্গে ২০ বছরের সৌমিত্রের দেখা হয়। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সেই সময় তাকে নেননি পরিচালক সত্যজিৎ। কিন্তু বেশি বয়সের অপুর জন্য ২০ বছরের যুবককে পছন্দ করে রেখেছিলেন তার অজ্ঞাতেই। দুই বছর বাদে সত্যজিৎ যখন ‘জলসাঘর’র শুটিং করছিলেন সেটে, যুবক সৌমিত্র গিয়েছিলেন। তখন শুটিং শেষ হওয়ার পর সৌমিত্রকে নিয়ে ছবি বিশ্বাসের সামনে দাঁড় করান সত্যজিৎ। পরিচয় করাতে গিয়ে বলেন, এ হচ্ছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার ‘অপুর সংসার’-এর নায়ক। সেই শুরু। তার পরের পাঁচ দশক যেন রূপকথার মতো। সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি ছবির মধ্যে ১৪টি ছবিতেই তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
সত্যজিৎ পুত্র সন্দ্বীপ রায় এদিন বলেন, বাবার সঙ্গে এক আলাদা ক্যামিস্ট্রি ছিল সৌমিত্র কাকুর। তাকে ভেবেই বাবা ছবির চরিত্র তৈরি করতেন। পরে মৃণাল সেন, তাপস সিনহা থেকে অজয় কর, সব বিখ্যাত পরিচালকের ছবিতেই অভিনয় করেন সৌমিত্র। ‘দেবী’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘কাপুরুষ’, ‘আকাশ কুসুম’, ‘বাঘিনী’, ‘পরিণীতা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ থেকে হালফিলের ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘বেলাশেষে’, ‘সাঁঝবাতি’- একের পর এক অসংখ্য অভিনয়ের মণিমুক্ত ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির স্মৃতির ভা-ারে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কিছুদিন আগেই শুটিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নিজের জীবননির্ভর সিনেমা ‘অভিযান’-এর শুটিং সম্পূর্ণ করেছিলেন। তবে এই ছবি রিলিজ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করা সৌমিত্র প্রায় ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More