জমকালো আয়োজনে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের ৪ যুগ পূর্তি অনুষ্ঠান এই জনপদের কবি-সাহিত্যিকদের শিল্পকর্মকে সংরক্ষণ করা হবে-এডিসি তারিক

স্টাফ রিপোর্টার:সাহিত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হলো চুয়াডাঙ্গার সাংস্কৃতিক অঙ্গন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হলো চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের ৪৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য ‘৪ যুগ পূর্তি উৎসব’। সুদীর্ঘ ৪৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন চর্চাকে উদযাপন করতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন জেলার গুণীজন, প্রশাসন এবং বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ চত্বরে আয়োজিত এই জমকালো আয়োজনে মিশে ছিল ঐতিহ্য, প্রজ্ঞা এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আশাবাদ।
সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীতের সুরে সুর মিলিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। প্রধান অতিথি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বিএম তারিক-উজ-জামান এবং চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল আতাহার তাজ যথাক্রমে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসবের শুভ সূচনা করেন। এরপর শহিদ আলাউল ইসলাম হলে সংগঠনের সভাপতি ইকবাল আতাহার তাজের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ সেলিমের মনোজ্ঞ সঞ্চালনায় আলোচনা পর্ব শুরু হয়। সভার শুরুতে সংগঠনের প্রয়াত সদস্যদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক মেহেরাব্বিন সানভী।
আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন,  অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা শিক্ষা অফিসার ও ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জেসমিন আরা খাতুন, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের উপদেষ্টা ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি হামিদুল হক মুন্সী, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের উপদেষ্টা ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মুন্সি আবু সাইফ।

শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সাবেক সভাপতি সরদার আলী হোসেন, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সাবেক সভাপতি তৌহিদ হোসেন, দৈনিক সময়ের সমীকরণের প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক আজকের চুয়াডাঙ্গার প্রধান সম্পাদক বিপুল আশরাফ, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি কোরবান আলী মণ্ডল, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর চুয়াডাঙ্গা জেলা সংসদের সভাপতি হাবিবি জহির রায়হান, চুয়াডাঙ্গা জেলা লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা আসলাম হোসেন অর্ক, জীবননগর সাহিত্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম, দামুড়হুদা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি সার্থক আলীম, আলমডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ওমর আলী মাস্টার, কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহ-সভাপতি বজলুর রহমান জোয়ার্দ্দার, সংলাপ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি নজির আহমেদ প্রমুখ।

বেলা ২টায় সংগঠনের অন্যতম সহ-সভাপতি সরদার আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য পাঠের বিশেষ আসর—’পদধ্বনি’র ১৪৯৫তম পর্ব। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের লেখিয়ে সাহিত্যিকরা তাঁদের স্বরচিত লেখা পাঠ করে এই আসরকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন।

উৎসবের শেষ ভাগে ছিল এক আবেগঘন পর্ব—সংগঠনের অন্যতম সহ-সভাপতি তৌহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে প্রয়াত সদস্যদের স্মরণে ‘মরণে তোমারে হারায়ে যেন পাই’ শীর্ষক স্মরণানুষ্ঠান। প্রয়াত সদস্যদের কীর্তিময় জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন কবি গোলাম কবীর মুকুল, কাজল মাহমুদ, ইকবাল আতাহার তাজ, হামিদুল হক মুন্সী ও সরদার আলী হোসেন। এই পর্বটি পরিষদের দীর্ঘদিনের পথচলায় হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রদের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে প্রতিভাত হয়।

অনুষ্ঠানের সকল পর্ব শেষে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ চত্বরে এক অনানুষ্ঠানিক আড্ডায় মেতে ওঠেন লেখক-সাহিত্যিকরা। তারা এ আড্ডায় আগামী ২০২৭ সালে অনুষ্ঠেয় সংগঠনের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব জাকজমকভাবে পালনের অঙ্গীকার করেন।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বি এম তারিক-উজ-জামান বাঙালির চিরায়ত প্রজ্ঞার অভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সাহিত্যে সমৃদ্ধি একটি দেশ। আমাদের এখানে বহু জ্ঞানী গুণী সাহিত্যিক রয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতা কিন্তুু আজও বজায় আছে। তবে আমরা বাঙ্গালিরা এমন এক জাতি, আমাদের যদি বুদ্ধি ব্যবহার না করার কোনো প্রতিযোগিতা থাকতো তবে আমরা সেখানে সুপারিশপ্রাপ্ত হতাম। টিকটক করা, অন্যকে অনুকরণ করা, অপসংস্কৃতিকে নিজের ভিতর ধারণ করার কোনো প্রতিযোগিতা থাকলে সেখানেও সুপারিশপ্রাপ্ত হতাম।’
তিনি মাতৃভাষা বাংলার সঠিক ব্যবহার নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা বাঙালি, কিন্তুু সেটা শুধু নামেই। আমরা ঠিকমত বাংলা ভাষাও জানিনা… যারা ঠিক মত বাংলা-ই জানেনা তারা কবি সাহিত্যের মর্ম কি বুঝবে। এই বিষয়গুলোর পরিবর্তন আনতে হবে, এই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে পরিবর্তনগুলো আনতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের হাতে একটি করে বই দিতে হবে। বলতে হবে এটা কো-কারিকুলামের অংশ। এই বইয়ের ওপর কুইজ প্রতিযোগিতা হবে পুরষ্কারের ব্যাবস্থাও থাকবে। এভাবে ধীরে ধীরে শুরু করেন একসময় শিক্ষার্থীরা মজা পেয়ে যাবে এবং পড়া শুরু করবে।’ তিনি আরও অঙ্গীকার করেন যে, এই জনপদের কবি-সাহিত্যিকদের শিল্পকর্মকে সংরক্ষণ করা হবে এবং স্কুলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের জীবনী তুলে ধরা হবে, ‘এতে শিক্ষার্থীরাও বিকশিত হবে এবং গুণি ব্যাক্তিদের প্রতি সম্মানও প্রদর্শিত হবে।’

বিশেষ অতিথি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোস্তাফিজুর রহমান সাহিত্যকে ইতিহাস ও মানসিক বিকাশের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘সাহিত্য আমাদের মনের বিকাশ ঘটায়। যে ইতিহাস জানেনা তার ধ্বংস অনিবার্য। সাহিত্য কিন্তুু ইতিহাসকে ধারণ করে, লালন করে।’ তিনি তরুণদের অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানে সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ তরুনদের উপস্থিতি খুব কম। এই সাহিত্যের আসরে তরুনদের অংশগ্রহণ খুব জরুরি। এই সাহিত্যের আসরে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে তবেই তাদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে শিল্প সাহিত্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যখন সাহিত্যের ভিতর আসবে, তখন তার চিন্তা ও মানসিকতার একটি সুন্দর বিকাশ ঘটবে। তখন এই মাদক, জুয়া, ইভটিজিং, খারাপ আড্ডা এড়িয়ে চলা খুব সহজ হবে… সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে তাদের বিকশিত করতে হবে। সামনে দিন গুলোকে কিভাবে আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং তরুন সমাজকে কিভাবে এই শিল্প সাহিত্যের ভিতর অগ্রসর করা যায় সেইদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।’

শুভেচ্ছা বক্তব্যে দৈনিক সময়ের সমীকরণের প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন বলেন,  ‘৪ যুগপূর্তি মানে ৪৮ বছর, এটা অনেক লম্বা একটা সময়। এই সাহিত্য পরিষদে আমি প্রায় সময় আসতাম। আলি ভাইকে কেন্দ্র করেই এখানে আসা। আগে অনেক চাঞ্চল্যকর পরিবেশ ছিলো। এখানে কবিতা আবৃত্তি হতো, কেউ কেউ উপন্যাস বা কারো জীবনীগ্রন্থ পড়ছে। বেশ জমজমাট আড্ডা হতো।’
তিনি আরো বলেন, আমি আমার পত্রিকায় স্বপ্নচারী নামে শিশুদের একটি পাতা বের করতাম। এটা ছিলো খুব বাজে অভিজ্ঞতা। যাইহোক সব মিলিয়ে আজকের আয়োজন খুব চমৎকার ছিলো। এমন উৎসব আরো হোক। এবং আমার প্রত্যাশা থাকবে সাহিত্য পরিষদ সাহিত্য সংগঠনের ফেডারেশন হিসেবে কাজ করুক’।
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More