জাল রেজুলেশন করে কুষ্টিয়ায় নাট্য সংগঠনের জমি বিক্রি

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়া শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত শত বছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন পরিমল থিয়েটার। প্রায় ২০ কোটি টাকার নিজস্ব মালিকানা এ সম্পত্তি জালিয়াতি করে বিক্রি করে দিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। কোনো সদস্য এমনকি নির্বাহী পরিষদকে না জানিয়ে ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে ভাইয়ের ছেলে ও নিজের স্ত্রীর নামে অর্ধেক জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে জালিয়াতি চক্রের হোতা ও পরিমল থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। সদস্যদের অভিযোগ, বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে নির্বাচিত কমিটিকে হটিয়ে রাতের আঁধারে দখলে নেয়া কমিটির দুই নেতা জালিয়াতি করে ওই জমিতে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছে। সেই ভবন নির্মাণেও চলেছে হরিলুট। নির্মাণ ব্যয় থেকে শুরু করে দোকান ঘর বিক্রিতে আত্মসাৎ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
সভাপতির অভিযোগ, সাধারণ সদস্য দূরের কথা আমি সভাপতি নিজেই একটি ইটের হিসাবও জানি না। সবই করেছে দুজন মিলে। এখানে কারো কোনো কথা বলার সুযোগ ছিলো না। শহরের নিয়ন্ত্রক হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য থিয়েটারের এমন দশায় ক্ষুব্ধ জেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা।
পরিমল থিয়েটারের প্রবীণ সদস্যরা জানান, সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়ার শিল্প-সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখতে ১৯১২ সালে জেলার কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তি পরিমল থিয়েটার স্থাপনের উদ্যোগ নেন। শহরের প্রাণকেন্দ্র এনএস রোডে ১৯ শতক জায়গায় গড়ে তোলা হয় বিশাল থিয়েটার ভবন। সেখানে নিয়মিত চলতো সাংস্কৃতিক চর্চা। অভিনেতা রাজু আহমেদ, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, কায়েস ও সুজাতা এবং গায়ক আবদুল জব্বার, খালিদ হোসেন, ফরিদা পারভীন, সোহরাব হোসেন, আনোয়ার উদ্দিন ও নার্গিস পারভীন ছাড়াও অসংখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, কবি সাহিত্যিক এ পরিমল থিয়েটার থেকে উঠে এসেছেন। তাই প্রভাবশালীদের দখল থেকে দেশের ঐতিহ্যবাহী থিয়েটারকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
জেলা রেজিস্ট্রি অফিসসূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দুই দলিলের মাধ্যমে পরিমল থিয়েটারের ১৯ শতক ৩৭ পয়েন্ট জমির মধ্যে প্রায় ১০ শতক জমি দুজনের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। যার দলিল নং ৬৯৫৩/১৪ এবং ৬৯৫৪/১৪। এর মধ্যে প্রথম দলিলে থিয়েটারের উপদেষ্টা ও ভাতিজা শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজের নামে ৮ শতক ৭১ পয়েন্ট এবং দ্বিতীয় দলিলে নিজের স্ত্রী মোছা. আয়েশা খাতুনের নামে ৯৭ পয়েন্ট জমি রেজিস্ট্রি করে দেন সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। দলিলে শনাক্তকারী ছিলেন থিয়েটারের সভাপতি সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু।
দলিলের ৬নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- পরিমল থিয়েটারের ২০১৪ সালের ১১ জুলাই বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে থিয়েটারের জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেই রেজুলেশনের কপিও দলিলের সঙ্গে জমা দেয়া হয়েছে।
তবে থিয়েটারের বর্তমান সভাপতি সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু বলেন, জমি রেজিস্ট্রির সময় আমি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় সাধারণ সম্পাদক তাহের ও উপদেষ্টা সবুজ দুইটা দলিল নিয়ে গিয়ে আমাকে স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি স্বাক্ষর দিতে না চাইলে অনেকটা জোরপূর্বক আমার কাছ স্বাক্ষর নেয়া হয়।
সভাপতি আরও বলেন, পরিমল থিয়েটারের কোনো বার্ষিক সাধারণ সভায় জমি বিক্রির কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। দলিল রেজিস্ট্রির সময় যে রেজুলেশন জমা দেয়া হয়েছে সেটি জাল রেজুলেশন। আমার স্বাক্ষর জাল করে রেজুলেশন জমা দেয়া হয়েছে।
বর্তমান কমিটির সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক জাহিদুল হক মতিন বলেন, এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কবে সাধারণ সভা হয়েছে, কবে জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। শত বছরের পুরাতন ঐহিত্যবাহী পরিমল থিয়েটার ভেঙে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সব কিছুই শুধু দেখছি কিন্তু কোনো কিছুর সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত না। আসলে নামেমাত্র আমি কমিটিতে আছি।
সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ, ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণেও কোটি কোটি টাকা হরিলুট করেছে সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। ৩০ লাখ টাকার দোকানের পজিশন বিক্রি দেখানো হয়েছে মাত্র ১৮ লাখ টাকায়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার প্রায় শতাধিক দোকানের পজিশন নির্বাহী কমিটির কোনো অনুমোদন ছাড়া সাধারণ সম্পাদক নিজের ইচ্ছামতো বিক্রি করেছেন। কেউ না জানলেও ভবন নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। কীভাবে কমিটির অনুমোদন ছাড়া ১৭ কোটি টাকা ব্যয় করলো-এমন প্রশ্ন তুলেছেন খোদ নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
পরিমল থিয়েটারের বর্তমান কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালের জানুয়ারি হতে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব নিরীক্ষা করিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। সেখানে আয় দেখানো হয়েছে ১৯ কোটি ২৪ লাখ ৯০০ টাকা। আর ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ৫০০ টাকা। এছাড়া ফ্লোর বিক্রি বাবদ ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাবটি নিরীক্ষা করেছেন শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা কাজী কাদের মোহা. ফজলে রাব্বি। তিনি নিরীক্ষণের ২নং পয়েন্টে বলেন, নিরীক্ষণকালে দেখা যায়- কোনো ক্যাশবহি লিপিবদ্ধ করা হয়নি। দ্রুত ক্যাশ বহি এবং অন্যান্য রেকর্ডপত্র নিয়মমাফিক লিপিবদ্ধ এবং সংরক্ষণ করতে বলা হয়।
জানা যায়, নির্বাচিত কমিটি শত বছর ধরে থিয়েটারটি পরিচালনা করে আসছিলো। ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত কমিটির সভাপতি ছিলেন সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান মতি। রাতের আঁধারে বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে নির্বাচিত ওই কমিটিকে হটিয়ে পরিমল থিয়েটার দখলে নেয় সেই সময় শহরের ত্রাস ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ। তিনি হন থিয়েটারের উপদেষ্টা। তারই আরেক সেনাপতি আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে রাতারাতি ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। সে সময় তাদের ওপর ছিলো পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ। প্রশাসন থেকে শুরু করে নেতাদের আস্থাভাজন ছিলেন তারা। তাই ভয়ে থিয়েটারের তিন শতাধিক সদস্যের কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।
সাবেক যুগ্ম সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীদের থাবায় দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠনটি হারিয়ে গেছে। থিয়েটারটি এখন বহুতল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি বলেন, জমি আত্মসাৎ করতে নির্বাচিত কমিটিকে হটিয়ে রাতারাতি দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠনটির দখল নেয় প্রভাবশালীরা। জালিয়াতি করে থিয়েটারের শত বছরের পুরাতন নিজস্ব সম্পত্তি বিক্রি করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি- ৮ বছরে বহুতল ভবন নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More