মিশু হাসান অস্ত্র-সোনা চোরাচালান ও ভারতীয় মুদ্রা তৈরির হোতা

অস্ত্র, বিদেশি মুদ্রা, ও সোনা চোরাচালান এবং ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা  মিশু হাসান। তিনি বাংলাদেশে স্থাপন করেছেন ভারতীয় জাল রুপি তৈরির কারখানা। জাল রুপি তৈরি করে ছড়িয়ে দিতেন সারা দেশে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায়। তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা কৌশলে এসব রুপি চালান করে দেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। শুধু জাল রুপির কারবারই নয়, তার সিন্ডিকেটে রয়েছে যেমন পেশাদার অপরাধী, তেমনি আছে পরিচিত মডেল ও শোবিজ অঙ্গনের বহু অভিনেত্রী।

অভিজাত এলাকায় মাদক ও নারী সরবরাহের মতো অনৈতিক কর্মকান্ড ছাড়াও সোনা, মুদ্রা এবং অস্ত্র চোরাচালানও চালিয়ে যেতেন মিশু ও তার সহযোগীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরে একের পর এক সোনা চোরাচালান ধরা পড়লেও আড়ালেই থেকে যান মিশু। কোনো তদন্ত সংস্থাই চোরাচালান মামলার এই হোতাকে অভিযুক্ত করতে পারেনি। তদন্ত করলেও পাওয়া যায় শুধু বাহককে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন মামলায় ৯ দিনের রিমান্ডে শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান, দুই মামলায় জিসানের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেফতারের পরই আলোচনায় আসে মিশু হাসানের নাম। মোহাম্মদপুর থানায় রাজীবের বিরুদ্ধে করা অর্থ পাচারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে মিশুর সংশ্লিষ্টতা পান সিআইডির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তারা। সিআইডি সূত্র জানায়, রাজীবের গাড়িবহরে গাড়ি এবং অস্ত্রের জোগানদাতা ছিলেন মিশু। এই তদন্তে তার নাম আসার খবর পেয়ে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান। সে সময়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে মিশুর সোনা এবং অস্ত্র চোরাচালানের সূত্র পাওয়া যায়। সোনার জন্য তিনি গুলশানের এক ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে দুবাইতে টাকা পাঠাতেন। এ ছাড়া মিশুর গুলশান এবং বনানীতে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে মাদক ও নারী সরবরাহ বাণিজ্যের চিত্র ধরা পড়ে রাজীবের মামলার অনুসন্ধানের সময়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, গরুর পেটে করে ইয়াবা, হীরা ও সোনা চোরাচালানে মিশু বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে ব্যবহার করতেন। মিশু নানা মাধ্যমে ইয়াবা, হীরা এবং সোনা চোরাইপথে আনলেও বিক্রির কাজে ব্যবহার করতেন পিয়াসাকে। বাড্ডা এলাকায় সান ডেইরি নামে একটি গরুর ফার্মের আড়ালে মূলত চলত তাদের এসব অপকর্ম। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের একটি সূত্র জানিয়েছে, মিশু, জিসান, পিয়াসা, পরীমণি, মৌ এবং রাজের অবৈধ আয়ের উৎসের সন্ধানে তারা ছায়া তদন্ত শুরু করেছেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির জানান, বিভিন্ন মডেলের ব্ল্যাকমেলিংয়ের তথ্য তারা পেয়েছেন। তাদের দৃশ্যমান তেমন কোনো আয় না থাকলেও বিলাসী জীবন-যাপনের নেপথ্যে কী আছে এবং তাদের সম্পদের উৎস কী- তা জানতে তারা ছায়া তদন্ত করছেন। সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন ঢাকার বাসিন্দা লুৎফুল হাসান। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় মুদ্রার বেশির ভাগই জাল থাকায় চিকিৎসা ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়েছিল তাকে। লুৎফুল সেসব রুপি সংগ্রহ করেছিলেন ঢাকার গুলশানের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে। শুধু লুৎফুলই নন, তার মতো অনেক বাংলাদেশিকেই ভারতে গিয়ে জাল রুপি নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। এসব ঘটনায় মাঝে মধ্যে অভিযোগ পেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভারতীয় জাল রুপির রহস্য উন্মোচন করতে হিমশিম খাচ্ছিল। অবশেষে জাল ভারতীয় রুপিসহ শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসানকে গ্রেফতারের পর সেই জট খুলতে শুরু করেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ সহজেই জাল টাকা চিহ্নিত করতে পারলেও রুপি চেনেন না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মিশু ও তার সিন্ডিকেট। চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে সারা বছরই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে যান। তাদের বেশির ভাগ নিজেদের প্রয়োজনীয় খরচের জন্য বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে যান ভারতীয় রুপি। নিজের এজেন্ট ও পরিচিত মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সেসব মানুষকেই বোকা বানাতেন মিশু। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জাল রুপির কারখানায় ভুয়া মুদ্রা ছাপাতেন। দেড় যুগ আগের সেই ছিঁচকে ছিনতাইকারীই এখন বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। জাল ভারতীয় রুপির কারবার করে স¦ল্প সময়ে দুই হাতে টাকা কামিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন মিশু।

অভিযানে অংশ নেওয়া এক র‌্যাব সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিশু হাসান যেন টাঁকশালের মালিক বনে গেছেন। ইচ্ছামতো ভারতীয় মুদ্রা উৎপাদন করেছেন তিনি। দেশীয় জাল টাকা চেনা সহজ। তাই ধুরন্ধর মিশু হাসান বৈদেশিক মুদ্রা উৎপাদন করে মানুষের চোখে ধুলা দিয়েছেন। মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্ধেক মূল্যে তাদের কাছে পৌঁছে দেন ভারতীয় মুদ্রা। চিকিৎসাসহ নানা কাজে ভারতগামী সরলমনা মানুষের কাছে এসব মুদ্রা তুলে দেয় এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলো। আর এতে মিশু হাসানের বাজিমাত। গত ৩ আগস্ট রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১ এর অভিযানে গ্রেফতার হন মিশু হাসান।

অস্ত্রের কাঁচামাল আমদানিতে জিসান : মিশু হাসানের সহযোগী মাহমুদুল হাসান জিসানকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জিসান মিশুর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ইয়াবাসহ অবৈধ এটিএম কার্ড তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। জিসান মিশুর ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা থেকে এসব জাল মুদ্রা সরবরাহ করতেন বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রগুলোতে। এমনকি তারা বেশকিছু ব্যাংকের বিপথগামী কর্মকর্তাকে এ কাজে লাগিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। তারা আরও জানান, বিদেশ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতেন জিসান। আর এসব কাঁচামাল থেকে দেশের দুর্গম এলাকায় কারখানা স্থাপন করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন করত তাদের এ সংঘবদ্ধ চক্র। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে সরবরাহ করতেন জিসান। মিয়ানমারের অস্ত্র বিক্রয়ের বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন মিশু হাসান ও জিসান।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More