৪৫ বছর ধরে ভাঁজা বিক্রি করছেন চুয়াডাঙ্গার আনছার মণ্ডল

ইসলাম রকিব: নাম আনছার আলী মণ্ডল। বয়স ৭৫’র কাছাকাছি। বাবা-মায়ের ৭ সন্তানের মধ্যে তিনি ২য়। বাবার অভাবী সংসারে টেনে-টুনে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পেরেছিলেন। তারপর বাবার সাথে সংসারের হাল ধরতে মোটরগাড়ীর হেলপারি, মাঠে কামলা দেয়া, বীজ গো-ডাউনের শ্রমিক হিসেবে কাজ করাসহ নানা শ্রমদায়ক কাজ করছেন আনছার আলী।
তিনি বলেন, তার বয়স যখন ২০ পেরুলো তখন বসতে হয়েছিলো বিয়ের পিঁড়িতে। বাবার অভাবের সংসারের যাতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে কবছর যেতে না যেতেই আনছার আলীর ঘরে চলে আসলো নতুন অতিথী। ‘অভাবে স্বভাব নষ্ঠের’ চিরচেনা সেই প্রবাদের মতো বাবার সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে হয় আনছার আলীকে। কি করবে? কোথায় থাকবেন, কি খাবেন? সন্তানকে কি খাওয়াবেন? সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে স্ত্রী-সন্তানকে বাবার বাড়ি রেখে বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে। চুয়াডাঙ্গার শহরের ইসলামপাড়ার নিজ পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে পায়ে হেটে মেহেরপুরের দিকে চলতে থাকেন। দেড় দিনের ক্ষুধার্ত আনছার আলীর পকেটে ছিল মাত্র ২০টাকা। দুপুর গড়িয়ে ভালাইপুর নামক বাজারে পৌঁছে ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক ভাঁজাওয়ালার নিকট আট আনার (৫০ পয়সা) ভাঁজা কিনে খান। চোখ-মুখের অবস্থাকে দেখে ভাঁজাওয়ালা বললেন তোমার কি হয়েছে বাবা?। কিছু হয়নি বলে চলে যেতে চাইলে লোকটি সেধে আনছার আলীকে ডেকে পাঁশে বসালেন। বিস্তারিত শুনলেন। এরপর বললেন, আমি কাল চুয়াডাঙ্গা থেকে মোট দু- কেজি ভাঁজা কিনে আনবো। তোমার কাছে ৫ টাকা হবে। এক কেজি তুমি বিক্রি করবে আর আমি বিক্রি করবো এক কেজি। কথা শুনে ১০ টাকা বের করে দিল আনছার আলী। সেদিন রাতে আনছার আলীকে ভাঁজাওয়ালা লোকটি তার বাড়ি রুইতনপুরে নিয়ে থাকতে দিয়েছিলো। পরদিন থেকে শুরু হলো দু-জনের ভাজা বিক্রির পালা। এভাবে মাস খানেক ভাঁজা বিক্রি করে উপার্জিত কিছু টাকা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরের ইসলামপাড়ায় চুপি চুপি স্ত্রী-সন্তানের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। দু-দিন থেকে আবারো ভালাইপুরে চলে এসে পুরাদমে ভাঁজা বিক্রি করতে থাকে আনছার আলী। এভাবে বছর দুয়েক পর স্ত্রী সন্তানদের আলাদা ভাড়া বাড়িতে রেখে ভালাইপুরের ভাজা বিক্রেতা ওস্তাদের দোয়া নিয়ে চুয়াডাঙ্গা চৌরাস্তার মোড়, কখনো একাডেমির মোড়, কখনো বালিকা বিদ্যালয়ের গেটে, কখনো বা ভিজে স্কুল গেটে ভাজা বিক্রি করেছেন তিনি। আলাপ চারিতার এক ফাঁকে আনছার আলী বলেন, ভিজে স্কুল গেটেই প্রায় ৪২বছর ঝাল, পিয়াজ, সরিষার তৈল ও গ্যাসের মসলা মিশ্রিত ভাজা বিক্রি করে আসছি। শহরের অন্য জায়গায় মাঝে মাঝে বসলেও আমার স্থায়ী ভাঁজা বিক্রির ঠিকানা ভিজে স্কুল গেটের ডান পাশের দেয়াল ঘেষা খুপরি জায়গাটি।
আনছার আলী বলেন, ৪৫ বছর ধরে ভাঁজা বিক্রি করে দু-ছেলে, দুই মেয়েকে সাধ্যমতো লেখাপড়া শিখিয়েছি। তাদের বিয়ে-সাদী দিয়েছি। ইসলামপাড়ায় নিজ নামে জমি কিনে পাকা বাড়ি করেছি। বড় ছেলে জহুরুলের অটো কিনে দিয়েছি ও ছোট ছেলে জাহিদুলকে টিকিয়া-চপের দোকান বানিয়ে দিয়েছি। এখন আর মন চাই না, শরীরে সাড়া দেয়না। এখন সব কিছু থেকে অবসর নিতে মন চাই। কিন্তু অবসর নিতে পারি না। সকাল হলেই মনে হয় স্কুলের বাচ্চারা হয়তো আমাকে খুঁজবে ভাঁজা খাওয়ার জন্য। আমি শুধু টাকা আয় করার জন্যই ভাজা বিক্রি করি না। ওদের স্বাস্থ্য যাতে না খারাপ হয় সেজন্য কষ্ট করে ভাঁজা-মসলা, পিয়াজ, ঝাল ও সরিষার তৈল ঢেকে রাখি। আবার ভাজা খেয়ে পেট যাতে না খারাপ হয়, সেজন্য গ্যাস না বাড়ার মসলা মিশিয়ে দেয় ভাজার সাথে। আমি মনে করি ভিজে স্কুলের সকল ছেলেরা আমার সন্তান। ওদের যেন ক্ষতি না হয়। দোয়া করি ওরা যেন লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে পারে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More