দাবি আদায়ে আন্দোলনে অনড় অবস্থানে : জবির ক্যাম্পাসে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাটডাউন দেশের তিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা : আন্দোলনের মুখে সরেছেন দুই উপাচার্য

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে দেশের তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রবল আন্দোলনের মুখে এরই মধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদ ছাড়তে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউন ঘোষণা করেছে শিক্ষক সমিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিতে মুখোমুখি অবস্থানে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) টানা ৮৬ দিন বন্ধ রয়েছে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু, নিরপেক্ষ নতুন তদন্ত কমিটি গঠন ও পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নে রোড ম্যাপ ঘোষণার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান নিয়ে গতকাল আবারও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা। ফের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। একাডেমিক কার্যক্রম চালু হওয়ার নবম দিন গতকালও ক্লাসে যাননি কুয়েটের শিক্ষকরা। এদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টানা ২৯ দিনের আন্দোলনের মুখে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চার দাবিতে অনড় জবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা: শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রইস উদ্দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে কাকরাইলে এই ঘোষণা দেন তিনি। অধ্যাপক রইস উদ্দিন বলেন, আমরা এখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার নিয়ে এসেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি আদায়ের জন্য এসেছি। আমাদের ওপর নির্বিচারে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অন্যায়। আমরা কারো বিরুদ্ধে এখানে কথা বলতে আসিনি এবং কোনো ষড়যন্ত্র করতেও আসিনি। আমাদের অধিকার চাইতে এসেছি। দাবি আদায় না করে আমরা ঘরে ফিরব না। এদিকে শিক্ষার্থীদের আগের তিন দফা দাবির সঙ্গে নতুন আরো এক দাবি যুক্ত হয়েছে। ১৪ মে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের অতর্কিত হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। এর আগের শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি হলো-বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে আবাসন বৃত্তি চালু করা, জবির প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করে অনুমোদন, দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ একনেক সভায় পাস ও বাস্তবায়ন।
ঢাবির ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রদল-শিবির মুখোমুখি অবস্থানে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, বাম সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ছাত্রদল এবং বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন ভিসি এবং প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে শিবির এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ বিদ্যমান প্রশাসনের পক্ষে অবস্থান দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মঙ্গলবার সাম্য নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢামেক জরুরি বিভাগে জড়ো হন তার বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। ছাত্রদল নেতাকর্মীদের একটি দল ঢামেক থেকে প্রথমে একটি মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন। এরপর উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ বের হয়ে এলে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। তার সঙ্গে উচ্চ বাক্য বিনিময় হয় ছাত্রদল নেতাদের। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘তোরা আমাকে মেরে ফেল’। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদল নেতারা তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে উদ্যানে স্পটে যান; যেখানে সাম্য নিহত হন এবং পরে ঢামেকে সাম্যকে দেখতে যান তারা। উপাচার্য বাইরে থাকতে থাকতে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবসহ মূল আরেকটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এসে তারা বিভিন্ন সেøাগান দেন। তারা উপাচার্য এবং প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তারা বুধবার দাবির পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা দেন। তখন সময় প্রায় রাত সাড়ে ৩টা। অন্যদিকে, উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ এবং প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদের ব্যাপারে শুরু থেকে ইতিবাচক দেখা গেছে শিবির হিসেবে পরিচিতদের আর কিছু শিক্ষার্থীর। তারা এ ঘটনায় উপাচার্য বা প্রক্টরের পদত্যাগের কোনো কারণ দেখেন না। তাদের মতে, ভিসি ও প্রক্টর ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা আনয়নের চেষ্টা করলেও বামপন্থি কতিপয় শিক্ষকদের বাধায় সেটা রাখা যায়নি। এখানে প্রশাসনের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এদিকে সাম্যকে হত্যার বিচার এবং ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে বৃষ্টিতে ভিজে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ছাত্রদল। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
টানা ৮৬ দিন কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ :গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের পর থেকে বন্ধ রয়েছে ক্লাস-পরীক্ষা। এ নিয়ে টানা ৮৬ দিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ আছে। এ অবস্থায় সেশনজট বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থী। নতুন করে আবার ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বিভিন্ন সেøাগানে সেøাগানে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে আসেন। পরে ভেতরে প্রবেশ করে ফ্লোরে বসে পড়েন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে গত সোমবার ৩৭ শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কুয়েট কর্তৃপক্ষ। ১৫ মে বিকাল ৫টার মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। অথচ তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। এ সময় তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে প্রহসনের অভিযোগ তুলেন তারা। উল্লেখ্য, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও বহিরাগতদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে দেড় শতাধিক আহত হন। ঐ দিন কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী কুয়েটের অপসারিত উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে মেডিক্যাল সেন্টারে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ঐ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ কয়েক জন শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত এবং গালাগাল করেন। এ ঘটনার পর থেকে কুয়েটে ক্লাস, পরীক্ষাসহ একাডেমিক সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কুয়েটে আগে থেকেই প্রায় দেড় বছরের সেশনজট রয়েছে। এর ওপর গত আড়াই মাস কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি। এ অবস্থা চলমান থাকায় বেড়েছে সেশনজট।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য ড. তৌফিক : এদিকে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে অপসারণের পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর নবনিযুক্ত উপাচার্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং মতবিনিময় করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা নিয়ে ইউজিসির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় ইত্তেফাকের সঙ্গে। তারা জানান, একজন শিক্ষক ভিসি হওয়ার পর তিনি নিজেকে প্রশাসক হিসেবে নিজেকে বেশি জাহির করতে চান। ফলে প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। আর ভিসিরা আগের ভিসিদের মনমানসিকতা এখনো লালন করছে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। ঢাবির প্রশাসনিক ভবনে সব রুমে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রশাসনিক ভবনে ‘জোরপূর্বক’ তালা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। এমনকি দুই মিনিটের মধ্যে প্রশাসন ভবন থেকে কর্মকর্তাদের বের হয়ে যাওয়ার আলটিমেটাম দেন তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাবি শাখা ছাত্রদল ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর একদল নেতাকর্মী প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে পড়েন। এরপর ভবনের সব রুমে রুমে গিয়ে সবাইকে বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর ছাত্রদল ও বাম নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেরিয়ে যান। এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান ভবনে ছিলেন না। দুপুর দেড়টার দিকে প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সব রুমে তালা ঝুলছে। কয়েক জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা (ছাত্রদল ও বাম) এসেই বলছে কোনো কার্যক্রম চলবে না, সব বন্ধ থাকবে। সবাই বেরিয়ে যান। এ সময় কয়েক জন কর্মকর্তার সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন বলেও জানান তারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ধর্ম সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সরকার, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, ক্রীড়া সম্পাদক সাইফ উল্লাহ সাইফ, কবি জসীম উদ্দিন হল ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিম, সূর্য সেন হলের প্রচার সম্পাদক প্রান্ত মাহমুদ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সংগঠক সীমা আক্তার প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুন্সী শামস উদ্দিন আহম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, অফিশিয়াল কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। শুধু ক্লাস ও পরীক্ষা অর্ধদিবস বন্ধ থাকবে, এরকম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল বুধবার। গতকাল আবার নতুন করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা পূর্ণ দিবস বন্ধ থাকবে। রেজিস্ট্রার আরো বলেন, ‘গতকাল দুপুরে একদল শিক্ষার্থী (ছাত্রদল ও বাম) রুমে রুমে গিয়ে বলেন, ‘দুই মিনিটের মধ্যে রুম থেকে বের হন। সবাই বাধ্য হয়ে বের হয়ে যান।’ উল্লেখ্য, ঢাবি শিক্ষার্থী ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধদিবস ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More