নারী সংস্কার কমিশন : সুস্থধারার তর্কবিতর্ক হোক

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে বৈষম্যের অবসান। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ধাপে ধাপে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ পায় এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটায়। আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে দিতে নারীদের অবদান ছিলো অসামান্য, অনেক ক্ষেত্রে মোড় বদলকারী। অভ্যুত্থান পরিবর্তনের যে জন-আকাক্সক্ষা তৈরি করেছে, তা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য কমিশনের পাশাপাশি নারী সংস্কার কমিশন করে। সম্প্রতি কমিশন তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ সরকারপ্রধানের কাছে জমা দেয়। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, নারী সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আসার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। কেউ কেউ কমিশন বাতিলেরও দাবি জানান। সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, নির্বাচনি ব্যবস্থাসহ ১১টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন করা হয়েছে। সব কটি কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অবস্থান দেখা গেছে। কিন্তু কেবল নারী কমিশনের ক্ষেত্রেই বাতিলের দাবি উঠেছে। সংবিধান ও আইনে নারীদের প্রতি যেসব বৈষম্য আছে, তা বিলোপের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মানবাধিকারকর্মী ও আন্দোলনকর্মীরা জানিয়ে আসছেন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সম্পদ-সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদে নারীকে সমান অধিকার দেয়া, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সুযোগ বন্ধ, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করাসহ নানা সুপারিশ করেছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নারীবান্ধব প্রস্তাব পেশ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। একটি কমিশনের সব প্রস্তাব সমাজের সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কমিশনের কোনো প্রস্তাবে আপত্তি কিংবা বিরোধিতা থাকলে সেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জানানোর সুযোগ রয়েছে। একটা সমাজ স্বাস্থ্যকর তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিকভাবে সামনে এগোয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক এ রীতিনীতিকে বিবেচনার মধ্যে না নিয়েই নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি উঠেছে। এমনকি সমাবেশ করে নারীবিদ্বেষী ও অবমাননাকর বক্তব্যও দেয়া হয়েছে। যদিও এর জন্য বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের কর্মকা- নারীর অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। উপরন্তু এ ধরনের কর্মকা-ে বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়। পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় উগ্রবাদ নারীর অগ্রযাত্রায় প্রধান অন্তরায়। অভ্যুত্থানের পর নারীরা তাঁদের পোশাক ও চলাফেরার জন্যও বাস্তব ও সাইবারজগতে নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। ধর্ষণসহ নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। কার্যত একটা গোষ্ঠীর দিক থেকে নারীদের পেছনে টেনে ধরার চেষ্টা দৃশ্যমান রয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত, এটা উদ্বেগজনক। একসময়কার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি। এই অগ্রযাত্রায় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও অনবদ্য অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধুলায় নারীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা এর বিশাল তরুণ জনশক্তি। নারী বা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বলি আর মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নই বলি, সেখানে পৌঁছানো বাস্তবে অসম্ভব। বৈষম্য বিলোপের মূল কথা হলো, নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা, সমান অধিকার। এর জন্য সবার আগে দরকার আইন, সংবিধানে যেসব বৈষম্যমূলক ধারা আছে, তার বিলোপ। এটা সত্যি যে সমাজ ও সংস্কৃতির শিকড়ে প্রোথিত নারীবিদ্বেষী মতাদর্শ ও আচরণ রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ, দেশ-কাল বিবেচনায় সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাব হয়তো এখনকার বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিকও নয়। কিন্তু এর জন্য নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত অতি জরুরি সংস্কারগুলো আড়ালে চলে যেতে পারে না। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সবখানেই সুস্থধারার তর্কবিতর্ক হোক।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More