আত্মসমর্পণ করবে না ইরান : যুদ্ধে জড়াতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইরান এবং ইসরাইলের পালটাপালটি হামলা গতকাল সপ্তম দিনে পৌঁছেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আত্মসমর্পণের আহ্বান জোর গলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। দুই নেতার বাকবিত-ার মধ্যেই ইরান ও ইসরাইলের একে অপরের ওপর হামলা অব্যাহত আছে। গতকাল তেল আবিব যেমন হামলা চালিয়েছে, তেমনি তেহরানও পালটা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। তবে তার প্রশাসনের কার্যক্রমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাই বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ইরান, এর জনগণ এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা ব্যক্তিরা কখনোই এই জাতির সঙ্গে হুমকির ভাষায় কথা বলেন না। কারণ ইরানিরা আত্মসমর্পণ করে না। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তার এই বক্তব্য পাঠ করা হয়। উপস্থাপক নিজেই এটি পড়ে শোনান। বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের যে কোনো রূপ নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মঙ্গলবার ইরানকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে খামেনি বললেন, ইরানিরা আত্মসমর্পণকারী নয়। এর আগে এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে খামেনি বলেন, ইরান কখনোই জায়নিস্টদের (ইহুদিবাদীদের) সঙ্গে আপস করবে না। সোশ্যাল মিডিয়া এক্সের একাধিক পোস্টে এ কথা লিখেছেন তিনি। খামেনি এক পোস্টে বলেন, আমরা জায়নিস্টদের (ইহুদিবাদীদের) কোনো দয়া দেখাব না। অন্য আরেকটি পোস্টে তিনি বলেছেন, যুদ্ধ শুরু।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের কূটনৈতিক মিশন। ইরানি আলোচকরা হোয়াইট হাউজে যেতে চান—ট্রাম্পের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে মিশনের এক পোস্টে বলা হয়, কোনো ইরানি কর্মকর্তাকে পা চাটার জন্য হোয়াইট হাউজের দরজায় বসে থাকতে বলা হয়নি। পোস্টটিতে বলা হয়, তার (ট্রাম্পের) মিথ্যার চেয়েও ঘৃণ্য জিনিস হলো ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে উৎখাতের বিষয়ে তার কাপুরুষোচিত হুমকি।
সিএনএন দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরানের ইসরাইলের হামলার যুক্ত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিষয়টি বিবেচনা করছেন। ঐ সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে। এর মাধ্যমে হয়তো ইরানকে পরমাণু চুক্তি করতে বাধ্য করা হতে পারে। যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কার মধ্যেই গতকাল বুধবার ভোররাতে পূর্ব ইংল্যান্ডে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়্যাল এয়ারফোর্স লেকেনহিথ থেকে অন্তত চারটি এফ-৩৫ বিমান ঘাঁটি ছেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এই বিমানগুলোর সঙ্গে একটি জ্বালানির ট্যাংকার বিমানও ছিল। এছাড়া ইরানের মাটির গভীরে তৈরি স্থাপনায় হামলা করতে পারে যে বি টু স্পিরিট বোম্বার বিমান, সেগুলোও ভারত মহাসাগরে ইরান থেকে ৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে একটি ঘাঁটিতে রাখা হয়েছে বলে জানা যায়। গত তিন দিনে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৩০টি সামরিক বিমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্পেন, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব বিমান ইরান-ইসরাইল সংঘাতের কারণে ইউরোপে নেওয়া হয়েছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। অন্যদিকে, বিবিসির মার্কিন সহযোগী সিবিএস নিউজের সূত্র বলছে, ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের কেন্দ্রগুলোতে হামলায় ইসরাইলের সঙ্গে যোগ দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যোগ দিলে চুপ থাকবে না তেহরান। পশ্চিম এশিয়াতে যে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, সেখানে হামলা চালাতে ক্ষেপণাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখছে ইরান। গোয়েন্দাদের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন দাবি করছেন মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। নিউ ইয়র্ক টাইমসও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা প্রায় তিন ডজন জ্বালানি ভরার বিমান পাঠিয়েছে ইউরোপে। মূলত আমেরিকান ঘাঁটি রক্ষা করতে যে যুদ্ধবিমানগুলো রয়েছে, সেগুলোকে সহয়তা করার জন্যই জ্বালানি ভরার বিমান পাঠিয়েছে আমেরিকা। তবে অনেকের মতে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলার কথা ভাবতে পারে আমেরিকা। সেই কারণেই আমেরিকার বোমারু বিমানে সহায়তার জন্যও জ্বালানি বিমানগুলো পাঠাতে পারে তারা।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চান, আমেরিকা এই যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করুক, যাতে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্র ফরদোতে বোমা ফেলুক আমেরিকা। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি গতকাল জানিয়েছেন, ইরানে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করতেও পারে, নাও করতে পারে। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছাড়াও নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির অনেকের কাছ থেকে ইরানে হামলার বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। গতকাল তিনি সেটি স্বীকারও করেছেন।
ইসরাইলের তেল আবিবের আশপাশের এলাকাগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ড। ইরানের গণমাধ্যমের খবরে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ইরান ইসরাইলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা তেল আবিব এবং হাইফায় হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা পূর্ব দিক থেকে উড়ন্ত দুটি ড্রোনকে নিষ্ক্রিয় করেছে। যেগুলো ইসরাইলের ডেড সি এলাকায় সাইরেন বাজিয়েছিল। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি আইআরআইবি জানিয়েছে, ইরানি সামরিক বাহিনী গতকাল বুধবার গতকাল সকালে ইসপাহানে একটি ইসরাইলি হার্মিস ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। নজরদারির জন্য ব্যবহূত বিধ্বস্ত মনুষ্যবিহীন ড্রোনের ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে তারা। এদিকে সরকারি সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, ইরানি সামরিক বাহিনী রাজধানী তেহরান থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে ভারামিন শহরের জাভাদাবাদ এলাকায় ইসরাইলের আরো একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। ভারামিনের গভর্নর হোসেইন আব্বাসির বরাতে আইআরএনএ আরো জানিয়েছে, ইরানি সেনাবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত যুদ্ধবিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে। ইরানের দাবি, গত ১৪ জুন ভোরে ইসরাইল বিনা উসকানিতে ইরানে আকস্মিক আক্রমণ শুরু করার পর থেকে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর গুলি করে ভূপাতিত করা পঞ্চম ইসরাইলি যুদ্ধবিমান এটা। ইসরাইল ইরানে ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে যুদ্ধবিমান ধ্বংসের কথা স্বীকার করেনি।
ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ জানিয়েছে, তাদের বিমান বাহিনী তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা শুরু করেছে। অন্যদিকে ইরানের ইসলামিক রিভ্যলিউশনারি গার্ড বলেছে, তেহরানের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলীয় শহরতলিতে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। ইরানের নিউজ সাইট তাবনাক বলছে, তেহরানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ ছাড়াও কারাজের বিভিন্ন এলাকায় হামলা করছে ইসরাইল। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, তাবরিজ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির অন্তত নয়টি ভবন ও ঘাঁটিতে পৌঁছানোর দুটি টানেল ইসরাইলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেহরানের পূর্ব উপকণ্ঠে অবস্থিত ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরাইল। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ এক্সে লিখেছেন যে, ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। তার দাবি এটি ইরানের সরকারের দমনমূলক কর্মকা-ের মূল কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে , ইরানের দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র ইসরাইলি হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে ইসরাইলও তাদের রাতভর হামলায় ইরানের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র আক্রান্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছিল। সেন্ট্রিফিউজ সিস্টেম ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More