রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে দীর্ঘ সাত বছর নেই কোনো আয়োজন আজ ৭ আষাঢ় : জনমানব শূন্য ঐতিহ্যবাহী মেটেরি মেলার মাঠ

নজরুল ইসলাম: আষাঢ় আসে শুধু বৃষ্টি নিয়ে নয়। সঙ্গে নিয়ে আসে প্রেম, বিরহ, স্মৃতি, আর প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের হাজার বছরের স¤পর্কের নতুন ব্যঞ্জনা। আষাঢ় মানে প্রকৃতির নবজন্ম, নতুন প্রত্যায়া, অর্ন্তনিহিত এক অনুভূতি। বর্ষা প্রকৃতি ও মানুষের হৃদয়ের বন্ধনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আষাঢ় শুধু বাংলা বার মাসের একটি মাস নয়। এটি বাঙালির জীবনের গভীর প্রতীক। যা বৃষ্টি প্রকৃতি ও মানুষের আবেগের এক অনন্য মিলনস্থল। আষাঢ়ের বর্ষা নামলেই জেগে ওঠে বাংলার নীল আকাশ, মাটির সুরভিত গন্ধ, নদী-খালের কল্লোলে ভাসে হাজারো গল্প। এই ঋতু বাঙালির হৃদয়ে বোনা থাকে এক অমোঘ সুর, যার রূপ, সুর ও স্মৃতি একসাথে বুনে দেয় এক অবিছেদ্য ঋতুগাঁথা। আষাঢ়ের বৃষ্টি শুধু জল নয়, এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কাব্যের অমর ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, মায়া থেকে মৎস্যজীবী সবাই এই ঋতুর বর্ণনায় গাঁথা। বৃষ্টির ফোঁটায় ফুটে ওঠে কদম ফুলের নৃত্য, পুকুর-খালের জলে জাগে নতুন প্রাণ, আর মাঠে নেমে আসে কৃষকের আশার আলো। একদিকে আষাঢ় কৃষিজীবীদের জন্য আশীর্বাদ। বিগত কয়েকটি আষাঢ়ের প্রথম দিবসে বৃষ্টি না হলেও এবারের আষাঢ় শুরু হয়েছে অতীতের রূপ নিয়ে। প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি আর মৃদু দমকা হাওয়া বয়ে চলেছে। আজ ৭ আষাঢ়। যেদিনটিকে ঘিরে চুয়াডাঙ্গার গড়াইটুপির গ্রামের মাঠে বটবৃক্ষের নিচে বসে ঐতিহাসিক গ্রামীণ মেলা। যা আজ অনুপস্থিত। আইনি জটিলতার কারণে এবারও ৮ম বারের মত বসছে না ঐতিহাসিক এ গ্রামীণ মেলা। তাই মেলা বসার কেন্দ্রটি বর্তমানে জনমানব শূন্য! শুনশান। নেই মানুষের পদচারণা। শুধু মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বটবৃক্ষ, মাজারের ঘর, নামাজ আর বিশ্রামের ঘরটি। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হচ্ছে না এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান ছিলো। যেখানে দেশের ৪২টি জেলার মানুষের সমাগম ঘটতো। চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি পরসা সাজিয়ে বসতো দোকানিরা। সবই আজ অনুপস্থিত। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট ঐহিতাসিক এ স্থানটি রূপকথার গল্প হয়ে থাকবে। এ গ্রামীণ মেলা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনাও কম ছিলো না।
প্রতিবছর বাংলা ৭ আষাঢ় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সাবেক তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপি গ্রামের মাঠে বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত খাজা মালিক-উল-গাউছের মাজারকে কেন্দ্র করে সরকারি শূন্য দশমিক ৪৭ একর খাস জমির ওপর বসে মেলা। গড়াইটুপির এ মেলাকে কেউ মেটেরি মেলা, কেউ অম্রবতি মেলা আবার কেউ অম্রবুচির মেলা নামে ডেকে থাকে। তবে গড়াইটুপির এ মেলা কবে কখন শুরু হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দষ্টভাবে কেউ দিন খন বলতে না পারলেও দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসাবে আনন্দ দিয়ে আসছে এ মেলা। শুরুর আগে থেকেই মেলার আশপাশ এলাকায় বেচা বিক্রির পরসা সাজিয়ে বসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দোকানিরা। ৯০’র দশকের পর এ মেলাটি বাণিজ্যিকভাবে রূপ নিলে সরকারের দৃষ্টি পড়ে। সামান্য জমি ইজারা দিয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে থকে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে এ মেলার মাঠ ইজারা দিয়ে সরকার রাজস্ব পায় ৪৮ লাখ টাকা। সরকার রাজস্ব পেলেও ইজারাদারকে গুণতে হয় মোটা অঙ্কের লোকশান। যার জের এখনও চলছে। সে মেলা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের ভিন্ন মত থাকায় শুরু থেকেই ইজারাদার এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে টান পড়েন চলে ঘটে নানা অঘটন। আইনের মার প্যাঁচে পড়ে অনেকেরই টানতে হয়েছে জেলের ঘানি। লোকশান আর তৎকালীন ক্ষমসীন দলের অভ্যান্তরীন রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে মাঝপথে মেলা বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইজারাতে কেউ অংশ গ্রহণ করেনি। অর্ধ কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব আর আয়োজনের আরও অর্ধকোটি মোট এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ঝুকি নিতে চাইছে না কেউ। ভবিষ্যতে আড়ম্বর ভাবে এ মেলা আয়োজন হবে কি না তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে ইতিহাস ঐতিহ্যের গড়াইটুপির মেলাটি আজ কাগুজে কলমে সিমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, ১৩ শতকের সূচনালগ্নে সুলতানী শাসনামল শুরু হয়। তখন থেকেই বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিলো। অবশ্য সে যোগাযোগের স্বরূপ ছিলো বাণিজ্যিক ও ধর্মীয়। তৎকালীন দক্ষিণ বঙ্গের ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে আর্বিভাব হন হযরত খানজাহান আলী (র.)। তিনি খুলনা বাগেরহাটে পৌঁছানোর আগে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সাবেক তিতুদহ ইউনিয়নের কালুপোল রাজার ভিটা নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। এখানে অবস্থান কালে কিছু অনুসারি গড়ে ওঠে তার। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.)। খানজাহান আলী খুলনা বাগেরহাটে চলে যাওয়ার সময় দায়িত্ব অর্পণ করে যান খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.) এর ওপর। সে সময় এ এলাকার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন গন্ধর্প রাজা। হিন্দু গন্ধর্প রাজার সাথে খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.) বিরোধ বাধলে তিনি রাজার ভিটা ছেড়ে মেলার মাঠের মোকামতলার এই জায়গাটিতে আস্তানা গড়ে তোলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করলে রাজা গন্ধর্প রায়ের সাথে চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। একপর্যায় তা যুদ্ধে রূপ নেয়। যুদ্ধে গন্ধর্প রাজা পরাজয় বরণ করে ভারতবর্ষে পালিয়ে যান। কিছু দিন পর খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.) মৃত্যুবরণ করলে তার অনুসারিরা খাজা মালিক-উল-গাউছ (র.) শরীর সমাধি করে এ বটগাছের নিচে। সেই থেকে মনবাসনা পূরণে ভক্তরা এখানে আসতে থাকেন। মনবাসনা পুরণের জন্য ভোজের আয়জনের পাশাপাশি বটবৃক্ষের শিকড়ে সুতা দিয়ে নুড়ি পাথর বেঁধে দেয়। মাজার নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর গ্রামীণ মেলা বসে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এখানে সাপ্তাহিক হাট বসতে শুরু করে। হাটের জায়গাটি ধীরে ধীরে রূপ নেয় বাণিজ্যিক মেলার কেন্দ্র হিসেবে। একপর্যায় এর পরিধি পায় ব্যাপকতা। প্রতিবছর ৭ আষাঢ় ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজন করা হয় গড়াইটুপির এ মেলা। এর ধারাবাহিকতার ব্যতয় ঘটে ২০১৭ সালে। এ ব্যাপারে তিতুদহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, জেলার ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক গড়াইটুপির এ মেলাটি। আইনি জটিলতায় তা আজ বিলিন হতে চলছে। আইনি জটিলতার কারণে আকাশচুম্বি ইজারা দিয়ে কেউ মেলা ইজারা নিতে চাইছে না। সরকার তার নিদৃষ্ট ইজারামূল্য না পেলে ইজারা দিচ্ছে না। তাই এ বছরও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না গড়াইটুপির এ মেলা। ভবিষ্যতে হবে কি না বলা যাচ্ছে না। তবে সরকার ইচ্ছা করলে খাস কালেকশনে মেলাটি চালু করলে ধীরে ধীরে আবার ঐতিহ্য ফিরে পাবে মেলাটি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More